জনমত গঠনের উপায় সমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: জনমত হলো জনসাধারণের সম্মিলিত অভিমত বা মতামত, যা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে গঠিত হয়। এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ সরকারের নীতি নির্ধারণ ও কার্যক্রম পরিচালনায় জনমতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে না। জনমত গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। জনমত গঠনে শক্তিশালী মাধ্যমগুলো সুস্থ ও সঠিক জনমত গঠনে সহায়ক হয়।
জনমতের সংজ্ঞা:
আরো পড়ুনঃ রাজা কোন অন্যায় করতে পারে না ব্যাখ্যা কর
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী জনমত সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। উদাহরণস্বরূপ:
- জে. এস. মিল বলেন, “কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় সমস্যার উপর জনগণের সংগঠিত অভিমতের নাম জনমত।”
- লর্ড ব্রাইস বলেন, “জনমত হচ্ছে সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের অভিতের সমষ্টি।”
- কিমবল ইয়ং এর মতে, “কোন নির্দিষ্ট সময়ে জনগণ যে মতামত প্রকাশ করে তাই জনমত।”
জনমত শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মতামত নয়; এটি একটি সম্মিলিত ধারণা, যা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। জনমত গঠনের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমের প্রয়োজন হয়।
জনমত গঠনের উপায়/মাধ্যমসমূহ:
১. পরিবার: পরিবার জনমত গঠনের প্রাথমিক মাধ্যম। পরিবারে ব্যক্তির প্রথম রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। বাবা-মা, ভাইবোনের মতাদর্শ এবং চিন্তাভাবনা ব্যক্তির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে, যা ভবিষ্যতে তার জনমত গঠনে সহায়ক হয়।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জনমত গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে। এসব ধারণা তাদের জনমত গঠনে সহায়ক হয়।
৩. আইনসভা: আইনসভা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। এখানে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, যা জনগণের মতামত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনসভায় উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জনমতের জন্ম হয় এবং তা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে।
৪. সংবাদপত্র: সংবাদপত্র জনমত গঠনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সংবাদপত্রে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়, যা জনগণকে বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতন করে তোলে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত মতামত, সম্পাদকীয় এবং পাঠকের মন্তব্যের মাধ্যমে জনমত গঠিত হয়।
৫. বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র: বেতার, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রও জনমত গঠনের শক্তিশালী মাধ্যম। বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের খবর এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রচারিত হয়। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অনেক সময় সামাজিক বার্তা ও জনমত গঠনের চেষ্টা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান আমলে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে সাহায্য করেছিল।
আরো পড়ুনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Spoil system’ কী?
৬. ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: জনমত গঠনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারও বড় ভূমিকা রয়েছে। ব্যক্তির নিজের অভিজ্ঞতা, তার পরিবেশ, এবং দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তার মতামত গঠিত হয়। এই অভিজ্ঞতা প্রায়ই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে।
৭. গোষ্ঠী প্রভাব: সামাজিক গোষ্ঠী, যেমন বন্ধু, সহকর্মী বা সামাজিক সংগঠন, জনমত গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে। মানুষ প্রায়ই তার সামাজিক গোষ্ঠীর মতাদর্শ বা মতামতের প্রতি প্রভাবিত হয় এবং সেই অনুযায়ী তার মতামত গঠন করে। পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের মতাদর্শ একজন ব্যক্তির রাজনীতি এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
৮. রাজনৈতিক দল: রাজনৈতিক দলসমূহ জনমত গঠনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। দলগুলো তাদের প্রচার কার্যক্রম, সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা, ও রাজনৈতিক ইশতেহারের মাধ্যমে জনমত গঠনের চেষ্টা করে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে তাদের কর্মসূচি তুলে ধরে এবং জনগণের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে জনমত তৈরি করতে সক্ষম হয়।
৯. সভা-সমিতি: বিভিন্ন সভা-সমিতি, বিশেষ করে রাজনৈতিক সভা, জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব সভায় রাজনৈতিক নেতারা জনগণের মধ্যে তাদের মতাদর্শ তুলে ধরে এবং তাদের মতামত গঠনে প্রভাবিত করেন। সভা-সমিতির মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো সম্ভব হয়।
১০. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম: বর্তমান যুগে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে দ্রুত জনমত গঠন করা যায় এবং এর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত জানা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনমত গঠিত হয়।
১১. ধর্মীয় সংঘ: ধর্মীয় সংঘ ও প্রতিষ্ঠান জনমত গঠনে বড় ভূমিকা পালন করে। ধর্মীয় নেতা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতাদর্শ জনগণের মধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মতামত গঠনের প্রধান উৎস।
১২. রেডিও-টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র: রেডিও-টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র জনমত গঠনের অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। এ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন বিষয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়ক হয়।
আরো পড়ুনঃ উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
১৩. সাহিত্য: সাহিত্য অনেক সময় জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে। একজন লেখকের চিন্তাভাবনা ও মতামত পাঠকের মধ্যে প্রচারিত হয় এবং তার লেখায় ফুটে ওঠা সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা জনমত গঠনে সহায়ক হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি বিপ্লবের সময় ভল্টেয়ার ও রুশোর লেখনী বিপ্লবী জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
উপসংহার: জনমত গঠনের উপায়সমূহ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনমত গঠনে বিভিন্ন মাধ্যমের ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়, কিভাবে একটি জাতি তার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মাধ্যমের মাধ্যমে গঠিত জনমতই একটি রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ ও কার্যক্রম পরিচালনায় প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করে।