মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Spoil system’ কী?
ভূমিকা: ‘Spoil system’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রথা, যা ১৯ শতকের প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল। এটি একটি নিয়ম যেখানে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে তার সমর্থকদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়। এতে সরকারি চাকরির জন্য রাজনৈতিক আনুগত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, আর যোগ্যতা ও দক্ষতাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই প্রথার উৎপত্তি, বিকাশ, সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এখানে।
Spoil System-এর উৎপত্তি:
‘Spoil system’ শব্দটি প্রথম চালু হয় ১৮২৮ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ক্ষমতায় আসেন। তিনি তার সমর্থকদের সরকারি চাকরিতে ব্যাপকভাবে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে এই প্রথার সূচনা করেন। জ্যাকসন বিশ্বাস করতেন যে, ক্ষমতায় আসার পর একটি দলের নিজস্ব লোকদের ক্ষমতায় বসানোই উপযুক্ত। এটি নতুন সরকারের জন্য জনগণের আস্থা ও সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করবে বলে তিনি মনে করতেন।
আরো পড়ুনঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
‘Spoil system’-এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের বিশ্বস্ত লোকদের সরকারে নিয়োগ দিতেন। এতে করে দলীয় সমর্থকরা সরকারি চাকরির সুযোগ পেতো, এবং এর ফলে সরকার পরিচালনায় তাদের ব্যাপক প্রভাব পড়তো। ক্ষমতায় আসার পর দলীয় সমর্থকদের মধ্যে এই চাকরি বিলি করার বিষয়টিকে “spoils” বা লুণ্ঠনের মতো মনে করা হতো।
লুণ্ঠনের ব্যবস্থা:
‘Spoil system’ শব্দটি ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মার্টিন ভ্যান বুরেন জনপ্রিয় করেন। তিনি এই প্রথাকে “লুণ্ঠনের ব্যবস্থা” বলে আখ্যায়িত করেন, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় আসার পর তাদের সমর্থকদের মধ্যে সরকারি চাকরিগুলি বিতরণ করতেন।
Spoil System এবং দক্ষ আমলাতন্ত্র:
‘Spoil system’-এর বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল, বিশেষত আমলাতন্ত্রের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে। সমালোচকরা বলতেন, এই প্রথা যোগ্যতা ও দক্ষতার বিকাশের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রধান বিষয় হিসেবে দেখা হয়, তবে দক্ষ এবং যোগ্য প্রার্থীরা পিছিয়ে পড়েন। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা এবং স্বচ্ছতা নষ্ট হয়।
এছাড়া, ‘Spoil system’ সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত করার জন্যও দায়ী ছিল। কারণ, চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া রাজনৈতিক সমর্থকরা প্রায়ই সরকারি পদগুলোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতেন। ফলে জনগণের সেবা করার বদলে, এসব কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা তাদের রাজনৈতিক দলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতেন।
Spoil System-এর সমর্থনকারীদের যুক্তি:
যদিও ‘Spoil system’ এর বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল, তবুও এর পক্ষে কিছু যুক্তিও দেওয়া হয়েছিল। এর সমর্থকরা বলতেন, এই প্রথা গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। যখন কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, তখন সেই দলের সদস্যরাই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় এবং তারা সরকারি কাজে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
আরো পড়ুনঃ ক্যাবিনেটের একনায়কতন্ত্র কি?
সমর্থকরা আরও বলতেন, ‘Spoil system’-এর মাধ্যমে সরকারকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়, কারণ ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সমর্থকদের মধ্যে সহজ যোগাযোগ ও বোঝাপড়া থাকে। এটি সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায় এবং প্রশাসনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
Spoil System-এর প্রথম সীমাবদ্ধতা:
১৮৮৩ সালের পেন্ডলটন সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট (Pendleton Civil Service Reform Act) ‘Spoil system’-এর বিরুদ্ধে প্রথম বড় পদক্ষেপ। এই আইনের মাধ্যমে ফেডারেল সরকারের চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা এবং দক্ষতার উপর গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পেন্ডলটন আইন অনুসারে, চাকরি প্রার্থীদের একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ করা হবে এবং রাজনৈতিক আনুগত্যকে বিবেচনা করা হবে না। এর ফলে, সরকারি চাকরিতে যোগ্য এবং দক্ষ প্রার্থীরা আরও বেশি সুযোগ পেতে শুরু করে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কমতে থাকে।
Spoil System-এর প্রতিক্রিয়া এবং ইতিহাস:
‘Spoil system’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলমান ছিল। এ সময় এটি মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি প্রধান নিয়মে পরিণত হয়েছিল।
১. বিরোধীদের যুক্তি: ‘Spoil system’-এর বিরোধীরা বলতেন, এই প্রথাটি সরকারকে অদক্ষ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত করে। রাজনৈতিক সমর্থকরা যোগ্যতার অভাবে সরকারি পদে নিযুক্ত হয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেন। অনেক ক্ষেত্রে, তারা সরকারি কাজের মানের পরিবর্তে নিজেদের দলীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন। এতে করে জনগণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং রাষ্ট্রের সেবার মান হ্রাস পায়।
২. পেন্ডলটন সিভিল সার্ভিস রিফর্ম অ্যাক্ট (Pendleton Civil Service Reform Act): ১৮৮৩ সালে পাস হওয়া এই আইনটি সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনে। এই আইন অনুযায়ী, যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হবে এবং রাজনৈতিক আনুগত্য আর মুখ্য বিষয় হবে না। এই আইন ‘Spoil system’-এর বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ ছিল।
৩. ‘Civil Service Reform Act of 1938’: ২০ শতকের মধ্যভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে ‘Civil Service Reform Act of 1938’-এর মাধ্যমে। এই আইন সরকারি চাকরিতে আরও স্বচ্ছতা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করে।
আজকের প্রেক্ষাপটে Spoil System:
আরো পড়ুনঃ যুক্তফ্রন্ট কী? ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি
আজকের যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘Spoil system’-এর প্রভাব অনেকটাই কমে এসেছে। অধিকাংশ নিয়োগই এখন যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে করা হয়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রভাব এখনো দেখা যায়, তবে যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া বর্তমানে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার: ‘Spoil system’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একসময় একটি প্রচলিত রাজনৈতিক নিয়ম ছিল, যা বিশেষত ১৯ শতকে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল। যদিও এটি গণতন্ত্রের একটি অংশ হিসেবে দেখা হতো এবং জনগণের সঙ্গে সরকারকে সংযুক্ত রাখার একটি উপায় বলে বিবেচিত হতো, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা এবং স্বচ্ছতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পেন্ডলটন সিভিল সার্ভিস রিফর্ম অ্যাক্ট এবং পরবর্তী আইনের মাধ্যমে ‘Spoil system’-এর বিরোধিতা করা হয় এবং বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে ইতিহাসে এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য এবং মার্কিন প্রশাসনিক ব্যবস্থা এর মাধ্যমে অনেক শিক্ষা লাভ করেছে।