গ্রামীণ সমাজসেবা কি? বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রম গুলোর বর্ণনা দাও।
ভূমিকা: গ্রামীণ সমাজসেবা হচ্ছে সমষ্টি উন্নয়নধর্মী একটি বহুমুখী পদক্ষেপ। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই গ্রামে বাস করে। গ্রামের অর্থনীতির বিকাশ সাধিত হলে সারাদেশের উন্নয়নে বেশ ত্বরান্বিত হবে। গ্রামের দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, নারী নির্যাতন ও অসামাজিক কার্যকলাপের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ সমাজসেবা এক যুগোপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়। তাই গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠন ও উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে গ্রামীণ সমাজসেবার ভূমিকা অনন্য।
গ্রামীণ সমাজসেবা: গ্রামীণ সমাজসেবা হচ্ছে এমন এক কর্মসূচি যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বহুমুখী সমন্বিত প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন কল্যাণ সাধনের পাশাপাশি বিদ্যমান গ্রামীণ অর্থনীতির গঠনমূলক পরিবর্তন আনয়ন। এটি এমন এক কার্যক্রম যার মাধ্যমে গ্রামের জনগণের তাদের প্রয়োজন পূরণ, সমস্যার বিকল্প সমাধানে নিশ্চিতকরণ এবং সেই সাথে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধানই প্রচেষ্টা চালানো হয়। অর্থাৎ সমাজসেবা কার্যক্রমকে গ্রামীণ এলাকায় সম্প্রসারণের মাধ্যমে সমন্বিত গ্রাম উন্নয়ন প্রচেষ্টার নামই গ্রামীণ সমাজসেবা।
আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা, প্রকৃতি, এবং বিষয়বস্তু
সাধারণ অর্থে: সাধারণ অর্থে গ্রামীণ সমাজসেবা বলতে গ্রাম উন্নয়নভিত্তিক বহুমুখী প্রচেষ্টার সমন্বিত রূপকেই বুঝায়, যার লক্ষ্য মূলত গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক কল্যাণ ঘটানো। নিত্যদিন উন্নয়নশীল দেশে এই গ্রামীণ সমাজসেবার গুরুত্ব বেড়েই চলেছে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: গ্রামীণ সমাজসেবার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংজ্ঞা নিম্নরূপ
সমাজসেবা অধিদফতর প্রকাশিত ‘Social services in Bangladesh’ গ্রন্থের সংজ্ঞানুযায়ী, গ্রামীণ সমাজসেবা হচ্ছে গ্রামোন্নয়নের সেই বহুমুখী ও সমন্বিত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ভূমিহীন ও সমস্যাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সাংগঠনিক প্রতিভা, নেতৃত্ব প্রদান এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ক্ষমতা বিকাশ সাধনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। যাতে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে সকল জনগণের সুষম ও সার্বিক কল্যাণ সাধন এবং মানব সম্পদের উন্নয়ন করা যায়। সুতরাং, সমন্বিত গ্রামীণ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার নামেই গ্রামীণ সমাজসেবা।
সমাজসেবাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (Social and Economic Commission of United Nations) মন্তব্য করেছেন, সমাজসেবা হলো ব্যক্তি এবং তার পরিবেশের মাঝে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্দেশ্যে গৃহীত ও সংঘটিত কার্যাবলির সমষ্টি।
বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রম বা কর্মসূচি: বাংলাদেশে পরিচালিত গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রম বা কর্মসূচিগুলো গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজসেবা কর্মসূচি বা কার্যক্রমগুলোর বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো:
আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
১. দল ও কমিটি গঠন: গ্রামীণ সমাজ সেবার প্রথম কাজ হচ্ছে আর্থ-সামাজিক জরিপের মাধ্যমে লক্ষ্যভূত পরিবার শনাক্ত করে কর্মীদল গঠন। সেই সাথে তাদের সংগঠিতকরণে গ্রাম সংগঠন তথা গ্রাম কমিটি গঠন করা। যাতে নারীরা প্রাধান্য পায়।
২. স্বাক্ষরজ্ঞান ও সামাজিক শিক্ষা প্রদান: নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করতে গ্রামীণ সমাজসেবা প্রকল্প লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় স্বাক্ষর জ্ঞান, সাধারণ মৌলিক জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে। এছাড়াও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে দানসহ শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। ২০০৪-২০০৫ ও ২০০৫- ২০০৬ অর্থবছরে যথাক্রমে ৭২, ২১২ জন এবং ৮৯, ৩৩০ জনকে স্বাক্ষর জ্ঞানদান করা হয়েছে।
৩. বয়স্ক কেন্দ্র: গ্রামগুলোতে বয়স্ক কেন্দ্র স্থাপনও গ্রামীণ সমাজসেবা কর্মসূচির অন্যতম অংশ। গ্রামের প্রবীণদের বিভিন্ন সমস্যার না। সুষ্ঠু সমাধান, সামঞ্জস্য বিধান, নবীন ও প্রবীণদের সম্মিলন ঘটানো আলোচনা ও পরামর্শ প্রভৃতি উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. যুবকেন্দ্র: যুবকদের (১৪-২৫ বছর বয়সী) সুসংগঠিত করে শ্রীণ গঠনমূলক কাজে নিয়োগ, বেকার ও বিদ্যালয় বহির্ভূত যুবকদের শ্রীণ প্রশিক্ষণ প্রদান, সচেতনতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নেতৃত্বের বিকাশ, এক স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা প্রভৃতি পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
৫. স্বেচ্ছাশ্রম: স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নয়ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি, সেতু নির্মাণ, খাল-খনন প্রভৃতি কার্যক্রমে জনগণকে উৎসাহিত করা হয়।
আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব
৬. সম্প্রসারিত পল্লি সমাজকর্ম: সম্প্রসারিত পল্লি সমাজকর্ম ১৯৭৪ সাল হতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান উদ্দেশ্যে হচ্ছে গ্রামীণ সমাজসেবার লক্ষ্যে অর্জন ও কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। এর আওতায় দেশের ৪৬১টি থানায় দরিদ্র, অসহায় নিঃস্ব ব্যক্তিদের ঘূর্ণায়মান ঋণ প্রদান করা হচ্ছে।
৭. শিশুকেন্দ্র: শিশু-কিশোরদের (৮-১৪ বছর বয়সী) সুপ্ত -। প্রতিভার এবং শারীরিক, মানসিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের লক্ষ্যে । শিশুকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। প্রত্যেক শিশুকেন্দ্র শিশুদের শিক্ষা, ম সামাজিকীকরণ, সচেতনতা সৃষ্টি প্রভৃতি কার্যক্রম নেওয়া হয়। আর বলা হয় প্রত্যেক ইউনিয়নে ৮টি করে কেন্দ্র থাকবে। কার্যক্রম: সামাজিক কার্যক্রম হচ্ছে গ্রামীণ র
৮. সামাজিক কার্যক্রম: সমাজসেবা কার্যক্রমগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কার্যক্রম। যাতে নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূরীকরণ, সচেতনতা সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি, নেতৃত্ব বিকাশ, দারিদ্র্য বিমোচন, টিউবওয়েল স্থাপন প্রভৃতি ■ অন্তর্ভুক্ত থাকে। দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে সামাজিক কার্যক্রমগুলো আরো জোরদার করা জরুরি।
৯. মা ও শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কে ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদান: আজকের শিশুই আগামী দিনের জাতির ভবিষ্যৎ। আর এ শিশু ভ্রুণ অবস্থা থেকে লালিত পালিত হয় মাতৃগর্ভে। তাই শিশু স্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ সমাজসেবা প্রকল্প মা ও শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কে ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদান করে থাকে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, শিশু ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।
১০. সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি: পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনায়ন কর্মসূচির গুরুত্ব অত্যধিক। গ্রামীণ সমাজসেবা প্রকল্পে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলাসহ আর্থিক সঙ্গতি রক্ষার্থে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন খুবই কার্যকরী। সামাজিক বনায়নের লক্ষ্যে সর্বশেষ ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ১,২৫,০০০টি বৃক্ষের চারা বিতরণ করা হয়।
১১. নেতৃত্বের বিকাশসাধন: এ কর্মসূচির আওতায় স্থানীয় নেতৃত্ব যেমন: ইউপি চেয়ারম্যান সদস্য ধর্মীয়, নেতৃবৃন্দকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমষ্টির উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সুযোগ দেওয়া হয়।
আরো পড়ুনঃ বেকারত্ব কি? বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণের উপায় সমূহ বর্ণনা কর
১২. পল্লি মাতৃকেন্দ্র স্থাপন: বাংলাদেশে ৩১৮টি উপজেলায় পল্লি মাতৃকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। গ্রামীণ সমাজসেবা সমাজকর্মীগণ দরিদ্র মহিলাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণদানের মাধ্যমে গ্রাম্য মহিলোাদের ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করেছে। এ কর্মসূচিতে মূলধনের পরিমাণ ৩৯ কোটি ৮০ লক্ষ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা। যার ফলে নারীরা তাদের কর্মের যথেষ্ট মর্যাদা পাচ্ছে।
১৩. সুদমুক্ত ঋণদান: সুদমুক্ত ঋণদানে গ্রামীণ সমাজ সেবার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত। গ্রাম এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ১৯৭৪ সালে ১৯টি থানায় পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়। বর্তমানে দেশের প্রতিটি উপজেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ কর্মসূচির আওতায় লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিসহ বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করে প্রত্যেককে ৫,০০০ থেকে ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এই কর্মসূচির মোট মূলধনের পরিমাণ আনুমানিক ২৬৫ কোটি ৩৩ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। এতে মোট সুফলভোগীর সংখ্যা ২৪ লক্ষ ১৫ হাজার জন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রামবাংলায় মানুষের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নে গ্রামীণ সমাজসেবার ভূমিকা অনন্য। আধুনিক বিশ্বে যে উন্নয়নের ছোঁয়া তার বিন্দুমাত্র নেই গ্রামগুলোতে। এহেন পরিস্থিতিতে গ্রামীণ সমাজসেবার দক্ষ সমাজকর্মীগণ নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাস্তবসম্মত কর্মপদ্ধতি অবলম্বনে নিঃস্ব, দীনহীন দরিদ্র মানুষের সার্বিক কল্যাণে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দানের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের শুভ সুচনা করেছে। তাই, বাংলাদেশের মত গ্রামপ্রধান দেশে গ্রামীণ সমাজসেবার কার্যক্রমগুলো অতি যত্নের সাথে গৃহীত হওয়া উচিত।