১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানের যতগুলো আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং আকারে বড় আন্দোলন হচ্ছে ১৯৬৯ সালের এই আন্দোলন। এই আন্দোলনে জনসাধারণের ব্যাপক সংমিশ্রণ ঘটে যার ফলে এটি গণঅভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর থেকে বিশেষ করে ১৯৬৯ সালে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাবলি এই অভ্যুত্থানের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। গণঅভ্যুত্থান মূলত ১৯৬৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি দেশব্যাপী সংগঠিত হয়েছিল। নিম্নে প্রশ্নের আলোকে তথ্যবহুল এবং গবেষণামূলক আলোচনা করা হলো:
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ: নিম্নে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো:
১. পূর্ববর্তী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা: ১৯৬৯ সালের আগেও অনেকগুলো আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের গড়ে তোলা হয়েছিল। যে আন্দোলনগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং প্রথম আন্দোলন ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। বাঙালিরা পরবর্তীতে আরো কয়েকটি প্রতিরোধ গড়ে তোলে উল্লেখযোগ্য ভাবে সফল হয়। যার ফলশ্রুতিতে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য জনসাধারণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠে।
২. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে বসবাস করলেও পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। এটি পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের সময় নিরাপত্তার ব্যাপারেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি উদাসীন ছিল। চাকরি, ব্যবসায় বাণিজ্যসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালিরা বঞ্চিত ছিল। এমন অবস্থার কারণেই ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান দানা বেঁধে উঠে।
আরো পড়ুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ
৩. ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন: ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু কর্তৃক লাহোরে উত্থাপিত ছয় দফা দাবি বাঙালি জীবনের ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বাঙালিরা এই দাবিকে নিজের দাবি বলে স্বীকার করে। সাধারণ জনগণ ছয় দফা দাবিকে বাঙালি জাতির মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করে। এই দাবিকে লক্ষ্য রেখে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে গণজোয়ার ঘটানো হয়।
৪. ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা: ১৯৬৮ সালে আগরতলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ তার অনুসারীদেরকে নিয়ে একটি গোপন মিটিং করা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসে। সরকার পক্ষ থেকে বলা হয় বঙ্গবন্ধুসহ তার অনুসারীগণ ভারতের সাথে আঁতাত করে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তাদের সবাইকে কুমিল্লা সেনানিবাসে আটক রাখা হয় মামলা দায়ের করার মাধ্যমে। পরবর্তীতে বিচারপতি এস. এ. রহমানের নেতৃত্বে ঢাকায় বিচার শুরু হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র প্রমাণ হওয়ার পূর্বেই তারা প্রহসনে লিপ্ত হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে বাঙালিরা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
৫. ছয় দফা দাবিসহ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থনস্বরূপ: ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলে তার মুক্তির দাবির জন্য লড়াই করতে হয়েছিল। যেটি গণআন্দোলন হিসেবে পরিগণিত হয়। এই আন্দোলনের ফলে মূলত ছয় দফা দাবিসহ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করা হয়েছিল। জনসাধারণ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে নিরঙ্কুশ সমর্থন গণঅভ্যুত্থানের একটি অন্যতম কারণ।
৬. আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন: পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আইয়ুব সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলার পর পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্রই আইয়ুব সরকার পতনের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
৭. সরকার কর্তৃক দমননীতি গ্রহণ: পুরো পাকিস্তানের জনগণ এক সময় আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল। তাদের এ আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ব্যবহার করেছিল ও তাদের উপর অত্যাচার শুরু করেছিল। পরবর্তীতে সরকারি নির্যাতন যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে আন্দোলন তত প্রকট হতে থাকে।
আরো পড়ুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ
৮. সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ছাত্র নেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু: ১৯৬৯ সালে ১৫ জানুয়ারি সৈনিকদের গুলিতে সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ছাত্রনেতার মৃত্যুর পর পাকিস্তানি আন্দোলন আরো তীব্র হয়। সমগ্র জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামী আন্দোলন গড়ে তোলেন। স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।
৯. জাতীয়তাবাদী মনোভাব: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদী চেতনা ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী হয়। আর এ সুসংহত জাতীয়তাবাদী চেতনার কারণেই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ জাগ্রত হয়। নিম্নে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য ফলাফল দেয়া হলো:
১. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান সরকার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি সরকার ভীত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উপর সমর্থন জানায়। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল আসামিদের বিনাশর্তে মুক্তি দেওয়া হয়।
২. শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। শেখ মুজিব সর্বস্তরের জনগণের নেতা হিসেবে পরিচিত লাভ করে। শেখ মুজিবের মুক্তির পর ১৯৬৯ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ রেসকোর্স ময়দানের এক গণসংবর্ধনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন।
আরো পড়ুনঃ আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি
৩. ২১-শে ফেব্রুয়ারির ছুটি পুনর্বহাল: ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ২১-শে ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিন ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সামরিক আইন চালুর পর এই ছুটি বাতিল করে দেয়া হয়। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে জাতীয় চেতনার প্রতীক ২১-শে ফেব্রুয়ারির ছুটি পুনর্বহাল করা হয়।
৪. আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিহয়। সারাদেশে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আইন লংঘন করে মিছিল ও আন্দোলন করে। যত বেশি আন্দোলন শুরু হয় তত বেশি আইয়ুব সরকারের ক্ষমতা নড়বড়ে হতে থাকে।
৫. গোল টেবিল বৈঠকের আহ্বান ও বর্জন: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার জন্য গোল টেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন। এই বৈঠক ফেব্রুয়ারী মাসে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু এই দাবি বাতিল করা হলে আওয়ামী লীগ বৈঠক ত্যাগ করে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রত্যক্ষ এবং শক্তিশালী সংগ্রামের ডাক দেন।
৬. আইয়ুব সরকারের অবসান: কঠোর আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য গভর্নর মোনায়েম খানকে সরিয়ে ড. এস. এন হুদাকে গভর্নর নিযুক্ত করেন। এ সময় গণঅভ্যুত্থান কিছুটা শান্ত হলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ -এ সামরিক আইন চালু করে। এর ধারাবাহিকতায় আইয়ুব খানের পতনের পর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
৭. ১৯৭০ সালের নির্বাচন: প্রচণ্ড চাপে পাকিস্তান সরকার সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য করে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পায়। প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন পায়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
৮. গণতান্ত্রিক মানসিকতা তৈরি: গণঅভ্যুত্থানের ফলে জনগণের মধ্যে স্বৈরাচার বিরোধী মনোভাব এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা তৈরী হয়। বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য জনগণ সর্বস্ব ত্যাগ স্বীকারের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি নিজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়।
৯. মুক্তিযুদ্ধের সূচনা: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়। যার ফলে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখ শহীদের তাজা প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করলে বাঙালি তাদের ঐতিহ্য ফিরে পায়। বাঙালিরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়।
আরো পড়ুনঃ যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
উপসংহার: উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ১৯৬৯ সালের তাৎপর্য অপরিসীম। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ছাত্র, জনতা, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুসহ সব বন্দি নেতাদের মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাঙালি স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। বিশ্ব দরবারে বাঙালিরা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।