সংস্কৃতির সংজ্ঞা

সংস্কৃতির সংজ্ঞা

ভূমিকা: সংস্কৃতি হলো মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার প্রণালী। এটি একটি সমাজের আদর্শ, মূল্যবোধ, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস এবং চেতনাবোধের সমষ্টি। মানুষের চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে সংস্কৃতি প্রকাশ পায়। এটি একটি সমাজের জীবনধারণ পদ্ধতির প্রতিফলন এবং সেই সমাজের লোকদের দ্বারা তৈরি একটি মানসিক ও সামাজিক কাঠামো। সংস্কৃতি মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, জীবনযাপন এবং বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সংস্কৃতির উৎপত্তি: সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ “Culture” ল্যাটিন শব্দ “Colere” থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো “কর্ষণ” বা “চাষ”। এই শব্দটি জীবনের প্রক্রিয়া বা জীবনযাত্রার প্রণালীর সাথে সম্পর্কিত। তাই সংস্কৃতিকে মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতি বলা যায়।

আরো পড়ুনঃ সমাজকর্মের সাথে সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক নিরূপণ

সংকীর্ণ অর্থে সংস্কৃতি: সংকীর্ণ অর্থে, সংস্কৃতি বলতে আমরা মার্জিত রুচি বা অভ্যাসজনিত উৎকর্ষতাকে বুঝি। এটি মানুষের শৈল্পিক উৎকর্ষ, রুচিশীলতা এবং আচরণের নিখুঁত প্রকাশ।

ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতি: ব্যাপক অর্থে, সংস্কৃতি মানুষের জীবনযাত্রার প্রণালী এবং জীবনধারণের প্রতিটি দিককে বোঝায়। এটি শুধু শৈল্পিক বা আচরণের উন্নতি নয়, বরং মানুষের সামগ্রিক জীবনধারা এবং সমাজের আদর্শ-প্রথা ও আচার-ব্যবহারকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

সমন্বিত সংজ্ঞা: সংস্কৃতির সঠিক সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংস্কৃতি কেবলমাত্র রুচি বা আচরণের উৎকর্ষতাকে বোঝায় না। এটি মানুষের জাগতিক চিন্তাধারা, সৃষ্টি, কর্মদক্ষতা, ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং সমাজের বিভিন্ন প্রথা ও প্রজ্ঞার প্রতিফলন। অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো মানুষের সামগ্রিক আচরণ এবং সমাজের আদর্শমূল্যগুলোর সমন্বয়।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, যেগুলো থেকে সংস্কৃতির গুরুত্ব ও অর্থ বোঝা যায়। তাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা হলো:

ম্যাকাইভার: “Culture is what we are” অর্থাৎ আমরা যা, তাই আমাদের সংস্কৃতি। এটি আমাদের জীবনধারা ও চেতনাবোধের প্রতিফলন।

ম্যালিনােস্কি: “মানুষের এমন সব কর্মই সংস্কৃতি, যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য অর্জন করে।” অর্থাৎ মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই তার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।

আরো পড়ুনঃ মানব ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব

E. B. Tylor (Primitive Culture গ্রন্থে): “Culture is that complex whole which includes knowledge, belief, art, law, custom and any other capabilities and habits acquired by man as a member of society.”

অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো জ্ঞানের, বিশ্বাসের, শিল্পের, আইনের, আচার-প্রথার এবং সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের অর্জিত বিভিন্ন ক্ষমতা ও অভ্যাসের জটিল সমন্বয়।

Encyclopaedia of Social Science: “সংস্কৃতি হলো মানুষের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্যবহারিক শিল্প, দ্রব্যসামগ্রী, কারিগরি প্রণালী, ধারা, অভ্যাস ও মূল্যবোধ।”

কুলি, এঞ্জেল, এবং কার: “Culture is the sum total of transmittable result of living together.” অর্থাৎ একত্রে বসবাস করার ফলস্বরূপ যা বংশপরম্পরায় চলে আসে, তাই সংস্কৃতি।

কার্ল মার্কস: “Culture is super structure.” অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো একটি উপরি কাঠামো, যা মানুষের সামাজিক আচরণ ও জীবনধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

পি.এ. সোরকিন (Social and Cultural Dynamics গ্রন্থে): “দুটি ব্যক্তির চেতন ও অচেতন ব্যবহারের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ফলাফলই সংস্কৃতি। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, কলা—সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।”

উপসংহার: সংস্কৃতি হলো মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রা, চিন্তা-চেতনা ও আচরণের ফলাফল, যা সমাজের প্রতিটি সদস্যের জীবনকে পরিচালিত করে। এটি শুধুমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত রুচি ও আচরণকে গঠন করে না, বরং পুরো সমাজের আদর্শ, মূল্যবোধ এবং সমাজের অস্তিত্বকে সুশৃঙ্খল রাখে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252