পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা: পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের লোক তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করবে এ চুক্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য ন্যায্য অধিকারের প্রতি মোটেই দৃষ্টি দেয়নি। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব হলো ১০০০ মাইল। দু’অঞ্চলের মধ্যে ছিল সবকিছুর ভিন্নতা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ঐক্যবন্ধন সুদৃঢ় করার একমাত্র উপায় ছিল একটি বৈষম্যহীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তা করেননি।

পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি শাসকগোষ্ঠী দু’অঞ্চলের দু’রকম নীতি অনুসরণ করেন। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে উন্নতি হয়, পূর্ব পাকিস্তানে সেখানে দুর্বল হয়ে পড়েছে। নিচে বৈষম্যের কারণগুলো আলোচনা করা হলো :

রাজনৈতিক বৈষম্য: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখাপেক্ষী করে রাখা হয়। লাহোর প্রস্তাবে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হলেও পাকিস্তানি শাসকরা প্রথম থেকেই এ বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করে। বারবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলার জাতীয় নেতাদের অন্যায়ভাবে জেলে বন্দী করে রাখে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত সরকারকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করে। পরবর্তী মন্ত্রিসভাগুলোকে বারবার ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকার্য অচল করে রাখে। অবশেষে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয় ।

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান

প্রশাসনিক বৈষম্য: পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি ছিল সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তারা। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়গুলোতে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার ৯৫৪ জনের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ১১৯ জন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ৪২০০০ কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র ২৯০০। ১৯৪৭ সালে করাচিকে রাজধানী করায় সরকারি অফিস-আদালতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্যাপক হারে চাকরি লাভ করে। সরকারের সব দপ্তরের সদর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে বাঙালির পক্ষে সেখানে গিয়ে চাকরি লাভ করা সম্ভব ছিল না। 

সামাজিক বৈষম্য: রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, ডাকঘর, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বিদ্যুৎ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশি সুবিধা ভোগ করত। সমাজকল্যাণ ও সেবামূলক সুবিধা বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানিরা পেত। ফলে সামগ্রিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত ছিল ।

শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য: শিক্ষাক্ষেত্রেও বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে-প্রাণে চেয়েছিল- পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি যেন শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার উন্নয়নের কোনো চেষ্টাই তারা করেনি। এছাড়া বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম করা বা আরবি ভাষায় বাংলা লেখার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় আঘাত হানতে চেয়েছিল। শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি চরম বৈষম্য দেখানো হয়। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে শিক্ষাখাতে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল ২০৮৪ মিলিয়ন রুপি এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৭৯৭ মিলিয়ন রুপি। পাকিস্তানের সর্বমোট ৩৫টি বৃত্তির ৩০টি পেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান এবং মাত্র ৫টি বরাদ্দ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ।

কৃষি উন্নয়নে বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তান কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি উন্নয়নের ব্যাপারেও এখানে সীমাহীন বৈষম্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে একর প্রতি উৎপাদনের পরিমাণ পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া এখানে বছরে ২/৩টি ফসল হয়। তাই কৃষির প্রতি নজর দিলে এখানে একটি গতিশীল অর্থনীতি গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলা করে পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষিখাতে অকাতরে অর্থব্যয় করেছেন। ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে বিশ্বের মোট ৮১% পাট উৎপাদনের গর্বিত দাবিদার পূর্ব পাকিস্তান। অথচ কৃষি উন্নয়নে সরকারের অবহেলার কারণে ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৩৫ শতাংশে ।

সামরিক বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক শাসনের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল সামরিক বৈষম্য। সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অতি নগণ্য। সামরিক বাহিনীর নিয়োগের ক্ষেত্রে যে কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাতে ৬০% পাঞ্জাবি, ৩৫% পাঠান এবং মাত্র ৫% পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অংশ ও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারণ করা হয়। বাঙালির দাবির মুখে সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও তা ছিল নগণ্য। ১৯৫৫ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, সামরিক বাহিনীর মোট ২২১১ জন কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ৮২ জন। ১৯৬৬ সালে সামরিক বাহিনীর ১৭ জন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন বাঙালি। আইয়ুব খানের শাসনামলে মোট বাজেটের ৬০% সামরিক বাজেট ছিল। এর সিংহভাগ দায়ভার বহন করতে হতো পূর্ব পাকিস্তানকে, অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার প্রতি অবহেলা দেখানো হতো।

আরো পড়ুনঃ যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ

সাংস্কৃতিক বৈষম্য: দুই অঞ্চলের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬%। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল হাজার বছরের পুরনো। অপরদিকে ৪৪% জনসংখ্যার পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল। উর্দুভাষী ছিল মাত্র ৩.২৭%। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষা ও সুসমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। প্রথমেই তারা বাংলা ভাষাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে এবং বাংলা ভাষাকে উর্দু বর্ণে লেখানোর ষড়যন্ত্র শুরু করে । বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত, নাটক, সাহিত্য। বাঙালি সংস্কৃতিতে আঘাত হানার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রচনাবলি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে হিন্দু প্রভাব বলে উল্লেখ করে সেখানেও বাধাদানের চেষ্টা করা হয়।

অর্থনৈতিক বৈষম্যঃ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও পূর্ববাংলার মানুষের স্বাধীনতা আসে নি। পাকিস্তানের মূল ক্ষমতায় থেকে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান চরম বৈষম্যের শিকার হয়। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয় নি। নিচে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য উল্লেখ করা হলো :

১. মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য: ১৯৪৯-৫০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের পূর্বাংশের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল। কিন্তু ১৯৫৪-৫৫ তে এ ব্যবধানের হার আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৯.৪৬ শতাংশ। আর এ বৈষম্যমূলক প্রবৃদ্ধির পেছনে শুধু প্রাক্ বিভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চতর অর্থনৈতিক বিকাশস্তরই দায়ী ছিল না, পরবর্তীকালে অনুসৃত নানারকম বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতিও এ ব্যবধান বা বৈষম্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সক্রিয় অবদান রেখেছিল।

২. রাজস্ব আয় ও ব্যয়ে বৈষম্য: সরকারি রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। নিয়ে ছকের সাহায্যে উভয় অঞ্চলের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখানো হলো : (১৯৬৫-১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮-১৯৬৯ সাল কোটি টাকায়)

খাতপূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তান
আয়৭২৮১৭৮১.৭
ব্যয়১৩৩৬.২২৭৬৭.১
ঘাটতি৬০৭.৭৯৮৫.৪
ঘাটতি পূরণ৬০৬.৭৯৮৫.৪

৩. ঋণ বরাদ্দে বৈষম্য: ঋণ বিতরণকারী সংস্থাসমূহ বিশেষত পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক, পাকিস্তান শিল্প ঋণ ও বিনিয়োগ কর্পোরেশন, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ এরূপ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বরাদ্দে বৈষম্য করে।

৪. অবকাঠামোগত বৈষম্য: ১৯৭০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫৫০ হাজার কিলোওয়াট। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৯৫৬ হাজার কিলোওয়াট। বার্ষিক মাথাপিছু বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহারে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ১৩ কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯২ কিলোওয়াট ঘণ্টা। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া সেনা ও নৌবাহিনীর সদরদপ্তর এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয়।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের অভভুদয়ে বাংলা ভাষার অবদান

৫. আঞ্চলিক বিনিয়োগে বৈষম্য: ১৯৫০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট বিনিয়োগের ২১% থেকে ২৬%। ১৯৬০ এর দশকে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩২% থেকে ৩৬%। অপরদিকে রাজস্ব ও উন্নয়নখাত মিলে পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা হয় প্রথম দশকে ৭৪% থেকে ৭৯% এবং দ্বিতীয় দশকে ৬৪% থেকে ৬৮%।

৬. বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ: এক দশকেরও অধিককাল ধরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা এবং সঠিক সেচ পদ্ধতির জন্য অভিযোগ করে আসছিল। ১৯৫৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা দেখা দেয় এবং তা বিশ্ব সংবাদে পরিণত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণে তেমন কিছুই করে নি ।

৭. বৈদেশিক সাহায্য ক্ষেত্রে বৈষম্য: ১৯৬৫ সালে চীন পাকিস্তানকে ৬০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার ঋণ দেয়। এর সিংহভাগ ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়নের জন্য ব্যয় হয় মাত্র ১,২৫,০০০ ডলার। এ সময়ে বিশ্বব্যাংক, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য প্রচুর ঋণ দেয়। এসব ঋণের বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য খরচ করা হয়।

৮. হস্তশিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা: দেশ বিভাগের সময় বাংলার তাঁতশিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯৪৭ সালে এখানে হস্তচালিত তাঁতশিল্প ছিল ২৫০ হাজার। ১৯৫১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৮৩ হাজারে। এখানকার হস্তশিল্পগুলো তুলা ও সুতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে।

৯. বিদ্যুৎ উন্নয়নে বৈষম্য : বিভিন্ন উপায়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল যথা ক্রমে ৮৩% ও ১৭%। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন বিদ্যুৎ উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৈদেশিক সাহায্যের একটা বিরাট অংশ ব্যয় করা হতো। সিন্ধু অববাহিকায় দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রায় ১,৮০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদার জন্য পাঁচ বছরের (১৯৫৯-৬৪) খরচ করা হয় ১,৪৫৩ মিলিয়ন ডলার।

১০. চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য : পাকিস্তানি শাসনামলে চাকরির ক্ষেত্রেও বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। সামরিক ও বেসামরিক চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানিদের বরাবর বঞ্চিত করা হয়। বিমান, নৌ সেনা, সদরদপ্তরগুলো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এসব দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল।

১১. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে মূল্যগত বিরাট ব্যবধান ছিল। দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে চাল ও গমের দর যথাক্রমে ৫০ ও ৩৫ টাকা প্রতি মণ ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে চালের দাম ছিল ১৮ টাকা এবং গমের দাম ছিল মাত্র ১০ টাকা। সুতরাং, এ থেকে যে বৈষম্য ছিল তা বুঝা যায়।

১২. সড়ক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈষম্য: দেশবিভাগের সমসাময়িককালের এক হিসেব থেকে দেখা যায় পাকিস্তানে উন্নত সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল মোট ৮,৩৫২ মাইল। পূর্ব-বাংলায় ছিল মাত্র ৭৫৭ মাইল অর্থাৎ মোট উন্নত সড়কের মাত্র শতকরা ৯.০৬ ভাগ। সে তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নত সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল ৭,৫৯৫ মাইল তথা মোট উন্নত সড়কের শতকরা ৯০.৯৪ ভাগ।

আরো পড়ুনঃ সামরিক শাসন বলতে কি বুঝ?

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য পাকিস্তানিরা চালান তা ছিল তাদের শোষণ ও নির্যাতনের পথ। এ বৈষম্যের জন্যই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ফলে সংঘটিত হয় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। আর এ অভ্যুত্থান থেকে পরবর্তীতে সংঘটিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর এ সংগ্রাম থেকেই পরবর্তীতে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের যা আজকের বাংলাদেশ।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263