মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও ব্রিটেনের লর্ডসভার তুলনামূলক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও ব্রিটেনের লর্ডসভার তুলনামূলক আলোচনা কর।

ভুমিকাঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং ব্রিটিশ লর্ডসভা উভয়ই তাদের দেশের দ্বি-কক্ষীয় আইনসভার উচ্চ কক্ষ। কিন্তু তাদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের ঐতিহাসিক পরিস্থিতির পার্থক্যের জন্য দ্বিতীয় কক্ষরুপে সিনেট এবং লর্ডসভার গঠন ও ক্ষমতার তারতম্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

নিম্নে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং ব্রিটেনের লর্ডসভার মধ্যে সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরা হলো।

সাদৃশ্য: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও ব্রিটেনের লর্ডসভার মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য বিদ্যমান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

  1. উভয় কক্ষই আইনসভার উচ্চকক্ষ।
  2. উভয় কক্ষের সদস্যদের মেয়াদকাল দীর্ঘ।
  3. উভয় কক্ষের সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও, উভয় কক্ষেই সদস্যদের নির্বাচিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট যোগ্যতা ও শর্তাবলী পূরণ করতে হয়।
  4. উভয় কক্ষের সদস্যদের আইন প্রণয়ন, বিধিবদ্ধকরণ, রাজস্ব বরাদ্দ, বিচার বিভাগের মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক চুক্তির অনুমোদন প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে।
  5. উভয় কক্ষই তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন ও প্রথার অধীনে কাজ করে।
  6. উভয় কক্ষেই সদস্যদের জন্য বিশেষ অধিকার ও সুবিধা রয়েছে।
  7. উভয় কক্ষই আইনসভার অন্যান্য কক্ষের তুলনায় বেশি মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

বৈসাদৃশ্য: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও ব্রিটেনের লর্ডসভা উভয়ই রাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ, তবে তাদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।

আরো পড়ুনঃ বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা কেন মান্য করা হয়?

১. গঠনঃ সিনেট ও লর্ডসভার গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। সিনেট ১০০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে সিনেট গঠিত হয়। অঙ্গরাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা তারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত। সিনেটের তুলনায় লর্ডসভার আয়তন ও সদস্যসংখ্যা অনেক বেশি।

বর্তমানে লর্ডসভার সদস্যসংখ্যা ১১০০ জন। তারা কেউই নির্বাচিত নন। বর্তমানে দু’ভাবে লর্ডসভার সদস্য পদ অর্জন করা যায়। উত্তরাধিকারসূত্রে এবং আজীবন পিয়ার বিষয়ক আইন অনুযায়ী। উত্তরাধিকারসূত্রে যারা লর্ডসভার সদস্য পদ লাভ করেন তারা হলেন ডিউক, মার্কুইস, আল ভাইকাউন্ট এবং ব্যারণ।

২. কার্যক্রমঃ মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার একটি সমমর্যাদাপূর্ণ কক্ষ। এটি আইন প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন এবং প্রেসিডেন্টকে অভিযুক্ত করার ক্ষমতা রাখে। লর্ডসভা যুক্তরাজ্যের আইনসভার উচ্চকক্ষ। এটি আইন প্রণয়ন, রাজার অভিষেক এবং নতুন আইনের বিরোধিতা করার ক্ষমতা রাখে।

৩. ক্ষমতাঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে কোন সাধারণ বিল সিনেট ও প্রতিনিধি সভার মধ্যে যে কোন কক্ষে উত্থাপন করা হয়। উভয় কক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন বিল কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে বলে ধরা হয় না। ব্রিটেনের সাধারণ বিল উত্থাপনের ক্ষেত্রে লর্ডসভা এবং কমন্স সভার ক্ষমতা সমান হলেও অপেক্ষাকৃতভাবে স্বল্প গুরুত্বপূর্ণ বিল ও বিতর্কমূলক নয় এমন বিলই লর্ডসভায় উত্থাপিত হয়।

লর্ডসভা ও কমন্স সভা কর্তৃক কোন বিল গৃহীত হওয়ার পরই গণ্য করা হবে যে, সংশিষ্ট বিলটি পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ বিলের ক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত লর্ডসভাকে কমন্স সভার কাছে নতি স্বীকার করতে হয়। কারণ লর্ডসভা কমন্স সভা কর্তৃক প্রেরিত কোন সাধারণ বিল এক বছরের বেশি আটক রাখতে পারে না। সুতরাং, সাধারণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও সিনেটের ক্ষমতা লর্ডসভার তুলনায় বেশি। সিনেটে সব রকমের বিলই উত্থাপিত হয়।

৪. স্বার্থের প্রতিনিধিত্বঃ মার্কিন সিনেট হচ্ছে অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক সভা ও অঙ্গরাজ্যের স্বাধিকারের প্রতীক। সিনেটের মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দাবি মূর্ত হয়ে উঠে। অন্যদিকে ব্রিটেনের লর্ডসভা বিশেষ স্বার্থের সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থের প্রতিনিধি। রক্ষণশীল মানসিকতা এবং কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূরূপে লর্ডসভা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি চিত্র

৫. সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেঃ সিনেট একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা। সিনেটরগণ স্ব-স্ব অঙ্গরাজ্যের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, লর্ডসভার সদস্যগণ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত নন। তারা সে পদে বহাল হন জন্মসূত্রে বা উত্তরায়িকারসূত্রে।

৬. সদস্যদের কার্যকালঃ সিনেটের সদস্যদের কার্যকাল ছয় বছর। প্রতি দু’বছর অন্তর ৩ এর ১ অংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করেন এবং শূন্য আসনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পক্ষান্তরে, লর্ডসভার বেশিরভাগ সদস্যই উত্তরাধিকারসূত্রে সদস্য পদ লাভ করেন। মনোনীত লর্ডগণও আজীবন সদস্য। সিনেটের গঠন গণতান্ত্রিক কিন্তু লর্ডসভার গঠন গণতান্ত্রিক নয়।

৭. নিয়োগ ও মন্ত্রী বিষয়ক ক্ষমতার দিক থেকেঃ মার্কিন সিনেটের হাতে নিয়োগ বিষয়ক যেসব ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে, লর্ডসভার সে ধরনের ক্ষমতা নেই। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতাই লর্ডসভার নেই।

পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত, পদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ সিনেটের অনুমোদন ছাড়া কার্যকর হয় না। মার্কিন রাষ্ট্রপতি অন্য রাষ্ট্রের সাথে যেসব সন্ধি ও চুক্তি করেন, সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সম্মতি ছাড়া তা কার্যকর হয় না।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস  বিফ সাজেশন

৮. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ প্রতিনিধি পরিষদ কর্তৃক উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচারকার্য সিনেটেই করা যায়। বিচারে অভিযুক্ত হলে কর্মচারীগণ পদ থেকে অপসারিত হন। অন্যদিকে, লর্ডসভা ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে কাজ করে, ফলে এক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করে। তবে সরকারি কর্মচারিদের বিচার বা অপসারিত করার ক্ষমতা ভোগ করে না।

৯. সন্ধি ও চুক্তির ক্ষেত্রেঃ মার্কিন রাষ্ট্রপতি অন্য রাষ্ট্রের সাথে যেসব সন্ধি ও চুক্তি করেন সিনেটের অনুমোদন ছাড়া তা কার্যকর হয় না। অন্যদিকে, ব্রিটেনের সরকার কর্তৃক কোন সন্ধি ও চুক্তি সম্পাদিত হলে তা বাতিল করার বা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা লর্ডসভার নেই।

১০. আর্থিক ক্ষমতাঃ আর্থিক বিষয়ে সিনেটের ক্ষমতা লর্ডসভার চেয়ে বেশি। অর্থবিল ও বাজেট প্রথমে প্রতিনিধি সভায় উত্থাপিত হলেও সিনেট অর্থবিলের নামকরণ ছাড়া যে কোন অংশে আমূল পরিবর্তন সাধন করতে পারে। অন্যদিকে, ব্রিটেনে অর্থনৈতিক বিষয়ে লর্ডসভা কমন্স সভার অনুগত কক্ষ।

অর্থবিল ও বাজেট কমন্স সভায় উত্থাপিত হয়। কমন্স সভা কর্তৃক গৃহীত কোন অর্থবিল ও বাজেট লর্ডসভা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। লর্ডসভা সুপারিশ করতে পারে মাত্র, কিন্তু তা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কমন্স সভার বিবেচনার উপর নির্ভরশীল।

১১. দলীয় প্রভাবের ক্ষেত্রেঃ মার্কিন সিনেটরগণ দলীয় সদস্য দ্বারা দলীয় প্রভাবে প্রভাবিত হন। কিন্তু ব্রিটেনে লর্ডসভার সদস্যগণ দলীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয় না। কারণ তারা দলীয় কাঠামোর ভিত্তিতে নির্বাচিত হয় না এবং কোন দলীয় কাজের সাথে জড়িত নয়।

১২. মর্যাদাগত দিক থেকেঃ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইনসভা কংগ্রেসের দু’টি কক্ষ সিনেট ও প্রতিনিধি সভার মধ্যে সিনেটই সবচেয়ে শক্তিশালী ও মর্যাদাবান। এজন্য অভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সিনেটের সদস্য হতে আগ্রহী। কিন্তু ব্রিটেনের পার্লামেন্টের দু’টি কক্ষ লর্ডসভা ও কমন্স সভার মধ্যে কমন্স সভা বেশি শক্তিশালী ও মর্যাদাবান। সে কারণে কেউ লর্ডসভার সদস্য হতে বেশি আগ্রহী নন।

আরো পড়ুনঃ ১৬০১ সালের এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইনের বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্কিন সিনেট ব্রিটেনের লর্ডসভার তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। সিনেটের ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান কিন্তু লর্ডসভার প্রভাব দ্রুত অপসৃয়মান। ব্রিটেনে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাস অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, উদারপন্থি গণতন্ত্র মার্কিন রাজনীতির অন্যতম ঝটিকা কেন্দ্ররূপে সিনেট পুঁজিপতি অর্থনৈতিক, সামাজিক বিন্যাসের অন্যতম রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263