প্রথা বলতে কী বোঝো? বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা কেন মান্য করা হয়?
ভূমিকা: সামাজিক জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়ােজন। একমাত্র সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই সুন্দর ও সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সমাজ পারস্পরিক সম্পর্ক ছাড়া গড়ে উঠতে পারে না। আর এই পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্রে আবদ্ধ জনগােষ্ঠির ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্প্রদায়, সংঘ, গােষ্ঠি, প্রথা বা লােকাচার, লােকরীতি জন্ম দিয়ে থাকে।
প্রথা: প্রথা বলতে বুঝায় সামাজিকভাবে স্বীকৃত এমন কিছু পন্থা বা রীতি ও পদ্ধতি যা বিভিন্ন সামাজিক কার্যকলাপ পালনে অনুশীলন করা হয়। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ অবচেতন মনেই প্রথাকে স্বীকার করে নেয়। ম্যাকাইভারের মতে, “The Socially accredited ways of acting are the customs of the society” সমাজ স্বীকৃত আচরণবিধি এবং কার্যপ্রণালিই হচ্ছে প্রথা। প্রথা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা- (১) নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম, (২) নিত্যদিনের কাজকর্মের পন্থা প্রণালি, (৩) পারস্পরিক সামাজিক আচরণ এবং ক্রিয়ার মধ্যে প্রতিফলিত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ।
প্রথার প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রথাগত বিধান বা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য ও মতামত ব্যক্ত করেছেন। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো:
আরো পড়ুনঃ গণতন্ত্রের সংজ্ঞা
Prof. A. V. Dicey বলেছেন, “দেশাচার হলো রাজা তার অবারিত ক্ষমতা কিভাবে কার্যকর করবেন এবং রাজনীতিনির্ধারণ করার নিয়মাবলি।”
Prof. K. C. Wheare-এর মতে, “শাসনতান্ত্রিক রীতি বলতে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত যেসব নিয়ম পদ্ধতি বুঝায় যেগুলো আইনের অংশ না হলেও বাধ্যতামূলকভাবে গৃহীত হয় ও দেশের রাজনৈতিক সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সুস্পষ্টভাবে শাসনব্যবস্থার একটি অংশে পরিণত হয়
Prof. Ogg বলেছেন, “প্রথাগত বিধান হচ্ছে এমন কতিপয় অভ্যাস বা বুঝাপড়া, যেগুলো সরকারি কর্তৃপক্ষ পারস্পরিক সম্পর্ক এবং ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।”
মার্শাল ও মুভি বলেছেন “Convention are non-legal rules regulating the way in which legal rules shall be applied.”
বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা মান্য করার কারণ: বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা বা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি কেন মান্য করা হয় নিম্নে তা উপস্থাপন করা হল:
১. জনমতের চাপ: ব্রিটেনের শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো মেনে চলার মূল কারণ হল জনমতের চাপ। এগুলোর পিছনে ব্রিটেনের জনগণের সুদৃঢ় সমর্থন সবসময় বর্তমান। এ জনসমর্থনই হল প্রথা মান্য করার মূল চালিকাশক্তি। কেননা জনসমর্থন হরানোর ভয়ে কোন দলীয় সরকার এগুলো অমান্য করতে পারে না।
২. ভারসাম্য রক্ষা: প্রথা ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।প্রথাকে অগ্রাহ্য করলে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা ভারসাম্যহীনতায় ভুগবে। এর ফলে ব্রিটেনের সরকারি কাঠামো গতিহীন হয়ে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিবে।
৩. ব্রিটিশ জাতির রক্ষণশীলতা ও ঐতিহ্যপ্রিয়তা: শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো ব্রিটেনের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস ও গৌরবময় ঐহিত্যের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ব্রিটিশ প্রকৃতিগতভাবে রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন হওয়ায় রীতিনীতিগুলোকে মান্য করার মধ্য দিয়ে তারা অতীত গৌরবকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ অনুভব করে।
৪. শাসনতন্ত্রের ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ: অতীতের সাথে বর্তমানের এবং বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের যোগসূত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথা অনবদ্য ভূমিকা পালন করে সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। তাই প্রথা মান্য করা হয়।
৫. রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ: সুদীর্ঘ কাল ধরে গড়ে উঠা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির পশ্চাতে জনগণের সুদৃঢ় সমর্থন থাকায় কেউ এগুলোকে উপেক্ষা করার সাহস পায় না। যদিও এগুলো অমান্য করায় কোন শাস্তির ভয় নেই, তবুও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে।
আরো পড়ুনঃ Political Organaization Previous year Brief
৬. নদনীয় ও গতিশীল সংবিধান প্রতিষ্ঠা: প্রথাগত বিধান সংবিধানকে নমনীয় ও গতিশীল করে। আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয় না এবং সম্ভব ও নয়। এক্ষেত্রে প্রথার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭. জনসমর্থন: গ্রেট বৃটেনের শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আছে। দেশবাসীর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে এগুলি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আইন ও রীতিনীতির মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক পার্থক্যের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ আগ্রহ দেখায় না। শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলি সহজবোধ্য হওয়ায় তা অধিক জনপ্রিয়।
৮. শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলির আইনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা: শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি অমান্য করলে তা আইনে পরিণত হবে এই আশঙ্কায় তা মান্য করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। যেমন লর্ড সভা ১৯০৯ সালে শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে কমন্স সভা কর্তৃক অনুমোদিত রাজস্ব বিল প্রত্যাখ্যান করে। তার ফলে লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাস করে ১৯১১ সালে পার্লামেন্টে আইন প্রণীত হয়। এ আইনের মাধ্যমে অর্থ বিলের ব্যাপারে লর্ড সভার ক্ষমতা প্রায় কেড়ে নেওয়া হয়।
৯. বাস্তব উপযোগিতা: সাংবিধানিক প্রথা লঙ্ঘন ব্রিটেনে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতাকে ক্ষুণ্ণ করে। তাছাড়া সাংবিধানিক রীতিনীতি সরকারকে সময়ের প্রয়োজনের সাথে খাপখাইয়ে নেয়। তাই এ বাস্তব উপযোগিতার উপলব্ধি রীতিনীতিগুলোকে মান্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। ফ্রিম্যান বলেছেন, “সাংবিধানিক রীতিনীতির গুরুত্বকে যেহেতু অস্বীকার করা যায় না, তাই এগুলোকে মান্য করা হয়ে থাকে।”
১০. শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা: শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করে তাকে সচল রাখে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে কার্টার, রেনি ও হার্জ বলেছেন, “রীতিনীতিগুলোকে অমান্য করা হলে শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে সরকারি যন্ত্র অচল হয়ে যাবে।”
১১. আইনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা: সাংবিধানিক রীতিনীতি অমান্য করা হলে তা আইনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এ সম্ভাবনা ও সাংবিধানিক রীতিনীতি মেনে চলতে বাধ্য করে। ১৯০৯ সালে লর্ডসভা সাংবিধানিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে কমন্সসভা কর্তৃক গৃহীত রাজস্ব বিলকে অগ্রাহ্য করে। আর এ কারণেই কমন্সসভা লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাসের জনা ১৯১১ সালের ‘পার্লামেন্টারি অ্যাক্ট’ বিধিবদ্ধ করে।
১২. ক্যাবিনেটের অস্তিত্ব রক্ষা: ব্রিটেনে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে ক্যাবিনেট গঠিত। ক্যাবিনেটের পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। কমন্সসভার আস্থা হারালে ক্যাবিনেটের পতন ঘটে, লর্ডসভার উপর কমন্সসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সাংবিধানিক প্রথাগুলো মান্য করা হয়, কারণ এসব প্রথা অমান্য করলে ব্রিটেনের ক্যাবিনেট শাসনব্যবস্থার বুনিয়াদই ভেঙে পড়বে। বিঘ্নবের সম্ভাবনা কমায
১৩. রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক কারণ: সাংবিধানিক রীতিনীতিগুলো অমান্য করলে আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করা যায় না বা অমান্যকারীর কোন শাস্তি হয় না বটে কিন্তু জনমনে বিরূপ প্রভাবের ভয়ে বা পরবর্তী নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে সবাই এগুলো মেনে চলে।
১৪. আইন লঙ্ঘনের ভয়: ডাইসি মনে করেন, প্রথা লঙ্ঘন করা মানে পরোক্ষভাবে সায়ীয় আইন লঙ্ঘন করা। কারণ অনুসারে ব্রিটেনে প্রতি বছর ছর পার্লামেন্ট অধিবেশন বসে এবং রাজস্ব আদায় হয়। এ রাজস্ব নিয়েই তারা সামরিক প্রথা বাজেট অনুমোদন করে। তাই প্রথা ভঙ্গ করলে এ সকল কাজ স্থগিত থাকবে এবং প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথার উপযোগিতা অপরিসীম। এর বাস্তব মূল্য ও অনেক। প্রথা সংবিধান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে সচল রেখেছে। এজন্য সরকার ও জনগণ সবাই প্রথাগত বিধান মেনে চলে।