ভদ্রবেশী অপরাধ বলতে কী বোঝায়?

ভদ্রবেশী অপরাধ বলতে কী বোঝায়?

ভদ্রবেশী অপরাধ বা “হোয়াইট কলার ক্রাইম” বলতে সেই ধরনের অপরাধ বোঝায়, যা সাধারণত উচ্চশ্রেণির শিক্ষিত ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা করে থাকেন। এ ধরনের অপরাধে সাধারণত কৌশল ও বুদ্ধির ব্যবহার হয় এবং তা লোকচক্ষুর আড়ালে সংঘটিত হয়। ভদ্রবেশী অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীরা সাধারণত সমাজের সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী শ্রেণির মানুষ হয়ে থাকেন। 

মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী এডউইন সাদারল্যান্ড প্রথমবারের মতো ১৯৩৯ সালে এই অপরাধের ধারণাটি উপস্থাপন করেন। সাদারল্যান্ড ভদ্রবেশী অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেন “বৈধ ব্যবসা বা পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে উচ্চশ্রেণির ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ” হিসেবে।

ভদ্রবেশী অপরাধের ক্ষেত্রে সাদারল্যান্ড উল্লেখ করেন, উচ্চশ্রেণির ক্ষমতাবান ব্যক্তি তাদের ক্ষমতা ও অবস্থানের অপব্যবহার করে অবৈধ কাজ করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা আইনের আওতায় আসেন না বা তাদের শাস্তি কম হয়। এটি মূলত আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে করা অপরাধ যা সমাজের নৈতিকতা ও আইনের পরিপন্থী।

আরো পড়ুনঃ মানব ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব

বাংলাদেশে ভদ্রবেশী অপরাধের প্রকৃতি:

ভদ্রবেশী অপরাধ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও একটি বড় ধরনের সমস্যা। দেশের দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা, অসৎ ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে এই ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে সাধারণত দেখা যায় কর ফাঁকি, ঘুষ, মজুদদারি, শেয়ারবাজারে কারসাজি, এবং মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রভৃতি।

বাংলাদেশে ভদ্রবেশী অপরাধের উদাহরণ:

১. আয়কর ফাঁকি: আয়কর ফাঁকি দেওয়া ভদ্রবেশী অপরাধের অন্যতম প্রধান উদাহরণ। অনেক ব্যবসায়ী, পেশাজীবী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি যথাযথ হারে আয়কর প্রদান করেন না। এমনকি অনেকে আয়কর দাতার নিবন্ধনই নেন না, যা দেশের আয়কর ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।

২. ঘুষগ্রহণ: ঘুষ গ্রহণ বাংলাদেশে একটি ব্যাপকভাবে সংঘটিত ভদ্রবেশী অপরাধ। সরকারি-বেসরকারি অফিসে কোনো কাজ সম্পাদনের জন্য অনেক সময় ঘুষ দিতে হয়। তবে সাধারণ জনগণ ঘুষ দিতে বাধ্য হলেও মূলত অফিসারদের লোভের কারণে এই অপরাধের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

3. শেয়ারবাজারে কারসাজি: শেয়ারবাজারে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে লোকজনকে প্রতারিত করে। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

আরো পড়ুনঃ সামাজিক আইন কাকে বলে 

4. মজুদদারি: খাদ্যদ্রব্য বা অন্য পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা ভদ্রবেশী অপরাধের আরেকটি উদাহরণ। এতে করে বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ চরম কষ্টে পড়ে।

5. মিথ্যা বিজ্ঞাপন ও প্রতারণা: মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য বিক্রি করাও ভদ্রবেশী অপরাধের অংশ। পণ্যদ্রব্য সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করা এবং মুনাফা করা এর মধ্যে অন্যতম। উদাহরণস্বরূপ, ফলের জুসের বিজ্ঞাপনে সেগুলোকে প্রাকৃতিক ফলের জুস হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তবে সেগুলোতে কেবল কৃত্রিম ফ্লেভার ব্যবহার করা হয়।

ভদ্রবেশী অপরাধের প্রভাব:

ভদ্রবেশী অপরাধের ফলে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে এবং আস্থার সংকট তৈরি হয়। যখন উচ্চশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অপরাধ করে শাস্তি এড়িয়ে যান, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। এ ধরনের অপরাধ আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক অবিচারও সৃষ্টি করে। তাছাড়া এসব অপরাধ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটায় এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে।

উপসংহার: ভদ্রবেশী অপরাধ আমাদের সমাজে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের অবস্থান ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাধ করে চলেছেন। এর ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি নৈতিকতার সংকটও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সুষ্ঠু আইনের প্রয়োগ এবং জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263