সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর
ভূমিকা: সংবিধান একটি রাষ্ট্রের মৌলিক আইন এবং পবিত্র দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে এবং রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় এই সংবিধানের আলোকে। সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য এবং শাসনব্যবস্থা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। এজন্যই সংবিধানকে ‘রাষ্ট্রের দর্পণ’ বলা হয়। সংবিধান রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখে এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করে।
সংবিধানের সংজ্ঞা:
সংবিধানকে ‘জাতির পবিত্রতম দলিল’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন ও সম্পর্ক নির্ধারণ করে। সংবিধান বিভিন্ন শাসন বিভাগের মধ্যে যেমন আইনসভা, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে। এরিস্টটল থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সংবিধানের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এরিস্টটল বলেন, “রাষ্ট্র নিজেকে পরিচালনার জন্য যে পথ বা নীতি গ্রহণ করে, তাই সংবিধান।” অধ্যাপক ফাইনারের মতে, “সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে পরস্পরের সম্পর্ক।”
আরো পড়ুনঃ গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য
সংবিধানের প্রকারভেদ:
সংবিধান বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, এবং এদের শ্রেণীবিভাগ কয়েকটি প্রধান ভিত্তিতে করা হয়, যেমন: লিখিত ও অলিখিত সংবিধান এবং সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান।
১. লিখিত ও অলিখিত সংবিধান:
লিখিত সংবিধান: যে সংবিধান নির্দিষ্ট একটি দলিলে লিখিত থাকে তাকে লিখিত সংবিধান বলা হয়। এই সংবিধানে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা, নাগরিক অধিকার, সরকারী ক্ষমতা ও দায়িত্বসমূহ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান।
অলিখিত সংবিধান: যে সংবিধান একটি নির্দিষ্ট দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে না, বরং বিভিন্ন আইন, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি এবং আদালতের রায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তাকে অলিখিত সংবিধান বলা হয়। যুক্তরাজ্যের সংবিধান অলিখিত সংবিধানের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
২. পরিবর্তনের ভিত্তিতে সংবিধান:
সুপরিবর্তনীয় সংবিধান: যে সংবিধানকে সহজেই সংশোধন বা পরিবর্তন করা যায়, তাকে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলা হয়। এক্ষেত্রে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে আইনসভার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হয়।
আরো পড়ুনঃ Sociology of Bangladesh Suggestion Session (2021-22)
দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান: যে সংবিধানকে সাধারণ আইনসভা দ্বারা সহজে সংশোধন করা যায় না, তাকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলা হয়। দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান সংশোধন করতে বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংশোধন করতে কঠোর বিধি পালন করতে হয়।
সংবিধানের বৈশিষ্ট্য:
সংবিধানকে একটি রাষ্ট্রের জন্য কার্যকর করতে হলে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক। নীচে উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:
১. সুস্পষ্টতা: একটি সংবিধানের নীতিমালা এবং ধারা স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। এর মাধ্যমে সংবিধানের বিভিন্ন ধারার অর্থ নিয়ে বিভ্রান্তি বা দ্বিমত দেখা না দেওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। এজন্য সংবিধানকে সহজ ভাষায় এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রণয়ন করা উচিত।
২. সংক্ষিপ্ততা: সংবিধানের ধারা ও উপধারাগুলো সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে অপ্রয়োজনীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত না হয়। তবে, রাষ্ট্রের কার্যক্রম এবং শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সব বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরা উচিত।
৩. মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্তি: সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হলে জনগণ স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। এটি নাগরিকদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. সময়োপযোগিতা: উত্তম সংবিধানকে অবশ্যই সময়োপযোগী হতে হবে। একটি সংবিধান সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে তবেই সেটি কার্যকর হবে। সংবিধান যদি সময়ের চাহিদা পূরণ না করতে পারে, তবে এটি জনগণের ইচ্ছার সাথে সংঘাতে লিপ্ত হতে পারে।
৫. সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য: উত্তম সংবিধান সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে। এতে আইনি এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের মধ্যে ভারসাম্য থাকা আবশ্যক। আইনগত সার্বভৌমত্ব হচ্ছে সরকারের শাসনক্ষমতা এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব হচ্ছে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন।
৬. গণতন্ত্রের প্রতিফলন: উত্তম সংবিধানে গণতন্ত্রের প্রতিফলন থাকা উচিত। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধান জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় এবং তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা করে।
৭. সহজ সংশোধন পদ্ধতি: একটি উত্তম সংবিধানের সংশোধন প্রক্রিয়া সহজ হতে হবে, তবে এমনভাবে যাতে সংবিধান অহেতুক পরিবর্তনের শিকার না হয়। সংবিধান সংশোধন সহজ হওয়ার কারণে সময়োপযোগী পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়।
৮. লিখিত রূপ: উত্তম সংবিধান লিখিত হওয়া আবশ্যক। লিখিত সংবিধান শাসনব্যবস্থা এবং নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর হয়। এতে সংবিধানের বিধিবিধানসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে।
৯. জনমতের প্রতিফলন: একটি উত্তম সংবিধান জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটায়। জনমতের ভিত্তিতে সংবিধান পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হওয়া উচিত। এটি সংবিধানকে সময়ের সাথে সাথে প্রাসঙ্গিক রাখতে সহায়ক হয়।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের অভভুদয়ে বাংলা ভাষার অবদান
১০. বিচার বিভাগের প্রাধান্য: সংবিধানের মান এবং প্রয়োগ নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের প্রাধান্য থাকা অত্যাবশ্যক। বিচার বিভাগের ওপর সংবিধানের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের দায়িত্ব থাকে, যা সংবিধান রক্ষা করতে সাহায্য করে।
উপসংহার: একটি উত্তম সংবিধানই হলো একটি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার মূলভিত্তি। সংবিধান জনগণের অধিকার এবং শাসনব্যবস্থা পরিচালনার সুষ্ঠু কাঠামো প্রদান করে। উত্তম সংবিধান সামাজিক স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রের অগ্রগতিকে নিশ্চিত করে।