সামাজিকীকরণ কী?
সামাজিকীকরণ বলতে মানুষের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সমাজের নিয়ম, রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবনযাপনের দক্ষতা অর্জন বোঝানো হয়। এটি মানবশিশুর জন্মের পর থেকে শুরু হয় এবং তার পুরো জীবন জুড়ে চলতে থাকে। সামাজিকীকরণের মাধ্যমে মানুষ ভাষা, আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি, এবং নৈতিক মান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে এবং সমাজে সফলভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে।
সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া:
একটি মানব শিশু জন্মগ্রহণের পরপরই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে মা-বাবা, এই প্রক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে শিশুর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ যেমন প্রতিবেশী, বন্ধু, শিক্ষক, এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তার সামাজিকীকরণে ভূমিকা রাখে। এই প্রক্রিয়ায় মানব শিশু ভাষা, সামাজিক নিয়ম, আচরণবিধি, এবং জীবন সম্পর্কে ধারণা পায়।
সামাজিকীকরণ একটানা চলতে থাকা একটি প্রক্রিয়া। এটি শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোর, যৌবন এবং পরিণত বয়সে প্রবেশের সময়ও চলতে থাকে। বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি নতুন নতুন সামাজিক নিয়ম, নীতি, এবং দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। সামাজিকীকরণ শুধু শেখানোর জন্য নয়, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা ব্যক্তিকে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত করে।
আরো পড়ুনঃ Previous Brief Sociology of Bangladesh
সামাজিকীকরণের প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানী সামাজিকীকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞা দিয়েছেন।
বোগারডাস (Bogardus) সামাজিকীকরণকে বর্ণনা করেছেন এভাবে: “সামাজিকীকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তি জনকল্যাণের নিমিত্তে একত্রে নির্ভরযোগ্য আচরণ করতে শেখে। এটি করতে গিয়ে সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ব ও সুসামঞ্জস্য ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করে।” অর্থাৎ, সামাজিকীকরণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা, দায়িত্বশীলতা, এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ গড়ে তোলে।
Kingsley Davis তাঁর Human Society গ্রন্থে বলেছেন, “যে প্রণালীতে মানব শিশু পূর্ণাঙ্গ সামাজিক মানুষে পরিণত হয় তাই সামাজিকীকরণ।” এই সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় যে সামাজিকীকরণ হল সেই প্রক্রিয়া, যা মানবশিশুকে সম্পূর্ণ সামাজিক মানুষে রূপান্তরিত করে।
Ogburn and Nimkoff বলেছেন, “যে পদ্ধতিতে ব্যক্তি নিজ নিজ মানবগোষ্ঠীর ব্যবহারিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়, তাই সামাজিকীকরণ।” অর্থাৎ, সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি তার গোষ্ঠীর মূল্যবোধ এবং আচরণবিধির সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে শেখে।
সামাজিকীকরণের উপাদান:
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া কয়েকটি প্রধান উপাদানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই উপাদানগুলো সামাজিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি তুলে ধরে:
পরিবার: সামাজিকীকরণের প্রাথমিক ও প্রধান সংস্থা হল পরিবার। পরিবার থেকেই শিশু প্রথম সামাজিকতা, ভাষা, এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে শিখতে শুরু করে। মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে শিশু সামাজিক আচরণের প্রাথমিক শিক্ষা পায়।
আরো পড়ুনঃ সমাজ বিজ্ঞান পরিচিতি বিগত সালের প্রশ্ন
বিদ্যালয়: বিদ্যালয় সামাজিকীকরণের দ্বিতীয় ধাপ। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে তাদের সহপাঠী এবং শিক্ষকদের মাধ্যমে সামাজিক আচরণের নিয়মাবলী শিখে। বিদ্যালয় তাদের শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিকীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বন্ধু ও সমবয়সীরা: শিশুরা তাদের বন্ধুদের মাধ্যমে সামাজিকীকরণের নতুন দিক শেখে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা করার সময় তারা দলগত আচরণ, সহযোগিতা, নেতৃত্বের গুণাবলি ইত্যাদি শিখে।
মিডিয়া: বর্তমান সময়ে সামাজিকীকরণে গণমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ নতুন নতুন সামাজিক ধারণা ও নীতি শিখতে পারে।
ধর্ম ও সংস্কৃতি: সামাজিকীকরণে ধর্ম এবং সংস্কৃতির প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ এবং উৎসবের মাধ্যমে সামাজিকীকরণের একটি বিশেষ দিক শেখা যায়।
সামাজিকীকরণের গুরুত্ব:
সামাজিকীকরণ একটি মানুষের জীবন গঠনে এবং সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু ব্যক্তির আচরণ এবং ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলে না, বরং তাকে সমাজের সদস্য হিসেবে গড়ে তোলে। সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি কীভাবে কথা বলতে হবে, কীভাবে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে, এবং কীভাবে সমাজের নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে তা শিখতে পারে।
সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ শেখা: সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি তার নিজস্ব সংস্কৃতির মূলনীতি এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। এটি তাকে সমাজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দিক বুঝতে সাহায্য করে।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণ: সামাজিকীকরণ ব্যক্তিকে সমাজের নিয়ম এবং বিধি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এর মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণ বজায় থাকে।
অভ্যন্তরীণ দক্ষতা: সামাজিকীকরণ ব্যক্তির ভেতরে কিছু অভ্যন্তরীণ দক্ষতা গড়ে তোলে, যেমন দায়িত্বশীলতা, নেতৃত্ব, এবং নৈতিক মূল্যবোধ।
পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো: সামাজিকীকরণ ব্যক্তি যাতে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে, সেই ক্ষমতা গড়ে তোলে। এটি তাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা দেয়।
আরো পড়ুনঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো দুটো সেক্টর সম্পর্কে লিখ
উপসংহার: সামাজিকীকরণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তি জীবন নয়, বরং সমাজকেও উন্নত করে। সামাজিকীকরণ মানুষকে সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও গুণাবলি শেখায়। সমাজের প্রতিটি স্তরে, যেমন পরিবার, বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এবং গণমাধ্যম, এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। সুতরাং, সামাজিকীকরণ ছাড়া সমাজে বেঁচে থাকা বা সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব।