রাষ্ট্রবিজ্ঞান কাকে বলে? রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের সর্বোত্তম/গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিটি আলোচনা কর।
ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political Science) হচ্ছে রাষ্ট্রের গঠন, শাসন প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা করা এক বিশেষ শাস্ত্র। এটি রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে এবং সমাজে পরিচালন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বোঝায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, কিভাবে সরকারের কার্যাবলি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়িত হয়, এবং কিভাবে একটি রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়ন ও উন্নয়ন ঘটে। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সমাজের এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিচিতি:
রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি সমাজবিজ্ঞান যা রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে। এটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, শাসন প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং আইনের শাসন নিয়ে গবেষণা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সুশাসন নিশ্চিত করা।
আরো পড়ুনঃ সংবিধান কি? উত্তম সংবিধানের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
অধ্যাপক গিলক্রিস্ট বলেছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে।” অধ্যাপক গেটেল বলেছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে।” অধ্যাপক বার্জেস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর আলোকপাত করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা:
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করার মাধ্যমে ব্যক্তি এবং সমাজ রাষ্ট্র ও সরকারের সঠিক তথ্য এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। এটি নাগরিকদের দায়িত্ব, অধিকার, এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়োজন, কারণ এটি জনগণকে সুশাসন, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের সর্বোত্তম পদ্ধতি:
রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের কার্যাবলি, নীতি এবং শাসন প্রক্রিয়া বোঝা সহজ হয়। এখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. ঐতিহাসিক পদ্ধতি (Historical Method): ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা হয়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিবর্তন, এবং ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানা যায়। এর মাধ্যমে আমরা রাষ্ট্রের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পোলক বলেন, “ঐতিহাসিক পদ্ধতি বর্তমান অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে অতীত থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।”
আরো পড়ুনঃ প্লেটোর সাম্যবাদ ও আধুনিক সাম্যবাদের পার্থক্য
২. পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি (Observational Method): পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন ঘটনা ও প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন ও কার্যপ্রণালী বুঝতে সহজ হয়। লর্ড ব্রাইস এবং লওয়েল এ পদ্ধতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছেন।
৩. পরীক্ষামূলক পদ্ধতি (Experimental Method): পরীক্ষামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের কার্যকলাপ এবং কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন। এ পদ্ধতিতে গবেষণা এবং বিশ্লেষণ করে নতুন নীতির কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। যদি কোনো পরীক্ষা সফল হয়, তবে তা অন্যান্য রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হয়।
৪. তুলনামূলক পদ্ধতি (Comparative Method): তুলনামূলক পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়। এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি, যা অ্যারিস্টটল দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছে। অ্যারিস্টটল ১৫৮টি গ্রিক নগর রাষ্ট্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তার রাষ্ট্রবিজ্ঞান তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন।
৫. আইনমূলক পদ্ধতি (Judicial Method): আইনমূলক পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রকে একটি আইনি সত্তা হিসেবে গণ্য করা হয়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন এবং আইনের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা হয়। গেটেল বলেন, “আইনমূলক পদ্ধতি রাষ্ট্রকে আইনি ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করে।”
৬. সাক্ষাৎকার পদ্ধতি (Interview Method): সাক্ষাৎকার পদ্ধতি রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষ বা বিশেষজ্ঞদের থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মতামত জানা সম্ভব হয়।
৭. পরিসংখ্যান পদ্ধতি (Statistical Method): পরিসংখ্যান পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান গবেষণায় বিভিন্ন সংখ্যা এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। এটি একটি অত্যন্ত আধুনিক পদ্ধতি, যা সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে সহায়ক হয়।
আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ
৮. প্রতিষ্ঠানগত পদ্ধতি (Institutional Method): এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কার্যাবলি বিশ্লেষণ করা হয়। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, রাজনৈতিক দল, এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়। এ পদ্ধতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যপ্রণালী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।
উপসংহার: রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতিকে সর্বোত্তম হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন। কারণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে জটিল সম্পর্ক রয়েছে, যা বিশ্লেষণ করতে বিভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। ঐতিহাসিক, তুলনামূলক, এবং পরীক্ষামূলক পদ্ধতিসহ অন্যান্য পদ্ধতির সমন্বয় করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করা সর্বোত্তম ফল দেয়।