প্লেটোর সাম্যবাদ ও আধুনিক সাম্যবাদের পার্থক্য:
ভূমিকা: প্লেটো ছিলেন প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এবং তাঁর চিন্তাধারায় তিনি রাষ্ট্রের আদর্শ শাসক হিসেবে দার্শনিক রাজার কথা উল্লেখ করেছেন। দার্শনিক রাজা এমন একজন শাসক যিনি তার জ্ঞান, নৈতিকতা, এবং শারীরিক দক্ষতার দ্বারা রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন। দার্শনিক রাজার মূল লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে, প্লেটোর সাম্যবাদ এবং আধুনিক সাম্যবাদের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে প্লেটোর দার্শনিক রাজার বৈশিষ্ট্য এবং প্লেটোর সাম্যবাদের সাথে আধুনিক সাম্যবাদের পার্থক্য তুলে ধরা হলো।
১. অর্থনৈতিক সমতা:
প্লেটোর সাম্যবাদ: প্লেটোর সাম্যবাদে সম্পদের সাম্যতা বা অর্থনৈতিক সমতা সরাসরি গুরুত্ব পায়নি। তিনি শাসকদের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিষিদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সম্পদে অসমতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। প্লেটো মূলত শাসকদের ও সৈন্যদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বর্জনের মাধ্যমে তাদের নির্লোভ এবং সৎ রাখার উপর জোর দিয়েছিলেন।
আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।
আধুনিক সাম্যবাদ: আধুনিক সাম্যবাদে সম্পদের সমান বণ্টন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক সাম্যবাদী মতবাদে চাওয়া হয় প্রতিটি ব্যক্তির অর্থনৈতিক সুযোগের সমতা এবং সম্পদ ও ক্ষমতার সুষম বণ্টন।
২. রাজনৈতিক সমতা:
প্লেটোর সাম্যবাদ: প্লেটোর সাম্যবাদে রাজনৈতিক সমতার কোনো স্থান ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শাসনকর্তারা হবে দার্শনিক রাজা, যিনি জন্মগতভাবে বা শিক্ষা দ্বারা শাসন করার উপযুক্ত। শাসকদের ক্ষমতা ছিল সর্বোচ্চ এবং তারা জনগণের উপরে থাকবে।
আধুনিক সাম্যবাদ: আধুনিক সাম্যবাদে রাজনৈতিক সমতা একটি মৌলিক ধারণা। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে প্রতিটি নাগরিকের ভোটাধিকার এবং সমান রাজনৈতিক অধিকার রয়েছে। সবাই সমানভাবে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতে পারে।
৩. সামাজিক সাম্য:
প্লেটোর সাম্যবাদ: প্লেটো সমাজকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছিলেন—শাসক, সৈন্য এবং শ্রমজীবী। প্লেটোর মতে, প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষের কাজ ও অবস্থান পূর্বনির্ধারিত এবং তারা নিজেদের কাজে মনোনিবেশ করবে। এখানে সামাজিক সাম্যের কোনো ধারণা ছিল না।
আরো পড়ুনঃ রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা | আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর ভূমিকা
আধুনিক সাম্যবাদ: আধুনিক সাম্যবাদ সমাজে শ্রেণি বিভক্তির বিরুদ্ধে এবং সব মানুষের মধ্যে সমান অধিকার ও মর্যাদার প্রয়াস করে। আধুনিক সাম্যবাদে শ্রেণীভেদকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং প্রতিটি নাগরিকের সমান সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
৪. ব্যক্তিগত স্বাধীনতা:
প্লেটোর সাম্যবাদ: প্লেটোর রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ছিল সীমিত। রাষ্ট্রের কল্যাণে এবং শাসকদের আদেশ অনুযায়ী ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হবে বলে প্লেটো বিশ্বাস করতেন।
আধুনিক সাম্যবাদ: আধুনিক সাম্যবাদে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারে এবং তার নিজস্ব চিন্তা ও জীবনধারা অনুসরণ করতে পারে।
৫. শিক্ষার ভূমিকা:
প্লেটোর সাম্যবাদ: প্লেটো বিশ্বাস করতেন, শুধু জ্ঞানী ও যোগ্য ব্যক্তিরাই শাসন করার অধিকার রাখেন। শিক্ষিত ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রের সঠিক পরিচালনা করতে পারে এবং বাকি মানুষকে সুশাসিত রাখে।
আধুনিক সাম্যবাদ:
আধুনিক সাম্যবাদে শিক্ষাকে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখা হয় এবং সবাইকে শিক্ষার সমান সুযোগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।
আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
উপসংহার: প্লেটোর দার্শনিক রাজা আদর্শ শাসকের প্রতীক, যিনি জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা এবং নৈতিকতার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করেন। অন্যদিকে, প্লেটোর সাম্যবাদ এবং আধুনিক সাম্যবাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো সম্পদ, রাজনৈতিক সমতা, এবং সামাজিক অধিকার নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আধুনিক সাম্যবাদ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সমতার উপর জোর দেয়, যা প্লেটোর সাম্যবাদের সঙ্গে বেশ কিছুটা ভিন্ন।