রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা

রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দাও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকাঃ রাজনৈতিক দল পদ্ধতি বর্তমান প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার এক অপরিহার্য অংশ। কার্যত রাজনৈতিক দলের সাহায্যেই দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এটি জনমত গঠনের একটি কার্যকরী উপায়। রাজনৈতিক দলসমূহ দেশের নির্বাচকমণ্ডলী এবং সরকারের মধ্যে এক অপরিহার্য সেতুবন্ধনস্বরূপ অবস্থান করে। সুতরাং দল ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ কল্পনা করা যায়।

রাজনৈতিক দলঃ সাধারণভাবে রাজনৈতিক দল বলতে এমন এক গোষ্ঠীকে বুঝায়, যা মােটামুটিভাবে সুসংহত ও সুসংগঠিত, একটি রাজনৈতিক ইউনিট হিসেবে কাজ করে, ভোট প্রদান ক্ষমতার মাধ্যমে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং সাধারণ নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে সরকারি ক্ষমতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রদত্ত রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা নিম্নরূপঃ

অধ্যাপক বার্কারের মতে, “কোনো একটি নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে ও যৌথ চেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থের উন্নতিকল্পে ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টিকে রাজনৈতিক দল বলে।”

আরো পড়ুনঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস  বিফ সাজেশন

অধ্যাপক গেটেল বলেন, “রাজনৈতিক দল এমন কিছু সংখ্যক সুসংবদ্ধ জনসমষ্টি নিয়ে গঠিত হয়, যারা ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠন ও নিজেদের কর্মসূচিকে কার্যকর করতে প্রচেষ্টা চালায়।”

অধ্যাপক কার্ল জে ফ্রেডারিকের মতে, “রাজনৈতিক দল হলো এমন একটি জনসমষ্টি, যারা স্থায়ীভাবে সংগঠিত এবং যার উদ্দেশ্য হলো এর নেতৃবৃন্দকে সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা; সরকারি ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দলের সদস্যদেরকে বস্তুগত সুবিধাদি প্রদান করা।”

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বা কার্যাবলিঃ গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক দল একে অপরের সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। রাজনৈতিক দলকে গণতন্ত্রের প্রাণ বলা চলে। বার্কারের মতে, “আমরা যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যথার্থ বলে স্বীকার করি, তাহলে দলীয় ব্যবস্থাকেও আমাদের স্বীকার করতে হবে।” গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংরক্ষণে রাজনৈতিক দলসমূহ সক্রিয় ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। নিম্নে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা আলোচনা করা হলো-

১. জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেঃ গণতন্ত্র অর্থ জনগণের শাসন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকে। এ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় নিয়ে সরকার গঠন ও পরিচালনা করে থাকে। আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলই জনগণের প্রতিনিধিত্বকে সম্ভব করে তোলে।

২. সুধু জনমত গঠনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের গুরুত্ব অপরিসীম। রাজনৈতিক দলসমূহ জনসাধারণের সামনে তার কর্মসচি ও মতামত উপস্থাপনের মাধ্যমে সুষ্ঠু জনমত গঠনে সাহায্য করে থাকে।

৩. প্রার্থী বাছাইঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রতিনিধি নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলসমূহ স্ব-স্ব দলের প্রার্থী বাছাই করে।

৪. সরকারের স্থায়িত্বঃ সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারেও দলীয় ব্যবস্থার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দল ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। দলীয় ও সাংগঠনিক কাঠামাে সুসংহত করার কারণে সরকারের স্থায়িত্ব লাভ সম্ভব।

৫. গণতন্ত্রের ধাপ বজায় রাখেঃ রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক শাসনের স্বরূপ বজায় রাখতে সচেষ্ট। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য।

৬. দরিদ্র ও যোগ্য প্রার্থীর সহায়তাঃ রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্য প্রার্থীদের আর্থিক এবং অন্যান্য সবরকম সাহায্য দিয়ে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ ও সফল হতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুনঃ সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা

৭. জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টিঃ রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে দলীয় নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে। জনগণকে জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করায়। ফলে জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়।

৮. সরকারের সমালোচনাঃ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদা সরকারের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখে। সরকারকে জনগণের স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করে। বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের অস্তিত্ব না থাকলে হয়তবা সকল সরকারই স্বৈরাচারে পরিণত হতো। এজন্য Prof. Ivor Jennings বলেছেন, “If there is no opposition, there is no democracy.”

৯. সরকার পরিবর্তনেঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে অতি সহজে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের বিরোধিতাকে কঠোর হস্তে দমন করার সুযোগ নেই।

১০. সরকার গঠনঃ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট দল সরকার গঠন করে। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে যথার্থভাবে সরকার পরিচালনা করে।

১১. সরকারকে দায়িত্বশীল করেঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলসমূহ ও নির্বাচকমণ্ডলী সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পায়। ফলে সরকার তার কার্যাবলির জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকে। কাজেই বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল না থাকলে সরকার দায়িত্বহীন হয়ে পড়ে।

১২. সমকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগঃ গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সরকার ও জনগণের মধ্যে ফলপ্রসূ ইতিবাচক সহযোগিতা ও যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলই সরকার ও জনগণের মাঝে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

১৩. সমস্যা সমাধানঃ রাজনৈতিক দলগুলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো বাছাই করে এবং সাথে সাথে সেগুলো সমাধানের ব্যাপারে সুচিন্তিত নীতি ও কর্মপন্থার নির্দেশ দেয়।

১৪. রাজনৈতিক শিক্ষাবিস্তারঃ রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষা ও চেতনার প্রচার-প্রসার ঘটায়। অসংখ্য সমস্যা ও তার সমাধানের ব্যাপারে দলগুলো প্রচেষ্টা চালায়। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, পত্রিকা এবং বিবৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে রাজনৈতিক দল জনগণকে সচেতন করে তোলে।

১৫. স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানঃ স্বাধীনতা আন্দোলনে জনগণকে সচেতন ও নেতৃত্ব দান রাজনৈতিক দলগুলোই করে থাকে। যেমন- ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নেতৃত্ব দান করেছিল।

আরো পড়ুনঃ ১৬০১ সালের এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইনের বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১৬. স্বৈরাচারের পথ রুদ্ধ করেঃ সাধারণত দল ব্যবস্থা স্বৈরাচারের পথ রুদ্ধ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত সরকারি দল বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না।

উপসংহারঃ রাজনৈতিক দলগুলোর উপযুক্ত ভূমিকা আলোচনা করলে এটা স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র অচল। এজন্য Prof. Bryce বলেছেন, “আধুনিক গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হচ্ছে দলীয় ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক দল হলো তার প্রাণ।”

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263