১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন

ভূমিকা: ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা মুসলিম নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়। এই আইনটি প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীদের অধিকার সুরক্ষা করা, বিশেষ করে বিবাহ, তালাক, দেনমোহর ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সমাজের অন্যান্য অসঙ্গতি দূর করার পাশাপাশি মুসলিম পরিবারব্যবস্থায় নারীদের সম্মান এবং সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করাও এ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

সামাজিক আইনের সংজ্ঞা:

সামাজিক আইন বলতে এমন বিধিনিষেধ এবং নিয়মের সমষ্টিকে বোঝায়, যা সমাজের মানুষের সামাজিক ও নৈতিক জীবন পরিচালনায় প্রভাবিত হয়। এটি সমাজের মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। সামাজিক আইন একপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম যা সমাজের উন্নয়ন এবং কল্যাণের জন্য প্রণীত হয়।

আরো পড়ুনঃ সমাজ সংস্কার কাকে বলে?

ডব্লিউ. উইলসন এর মতে, “সামাজিক আইন হলো সমাজের সেসব সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা বা রীতি-নীতি, যেগুলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং যেগুলোর পেছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সমর্থন রয়েছে।”

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন:

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ছিল বিশেষত মুসলিম নারীদের রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রণীত একটি আইন, যা মুসলিমদের পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিককে নিয়ন্ত্রণ করত। বিশেষ করে তালাক, দ্বিতীয় বিবাহ, ভরণপোষণ এবং উত্তরাধিকারের মতো বিষয়গুলোতে নারীদের নিরাপত্তা এবং অধিকার রক্ষার জন্য এ আইনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এটি ছিল শিশু ও মহিলাদের কল্যাণে একটি সামাজিক আইন, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করে।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ধারাগুলো:

১. বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক: এই আইনের মাধ্যমে মুসলিম রীতি অনুযায়ী হওয়া সব বিয়ে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে বিয়ের প্রমাণ থাকা এবং ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা এড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়।

২. দ্বিতীয় বিবাহের জন্য প্রথম স্ত্রীর অনুমতি: এই আইনের অধীনে, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ করা নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বিতীয় বিবাহের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সালিশ পরিষদের অনুমতি প্রয়োজন হয়।

৩. তালাকের জন্য নোটিশ প্রদান: এই আইনে বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি সরাসরি তালাক দিতে পারবে না। তাকে প্রথমে লিখিত নোটিশের মাধ্যমে স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং তার স্ত্রীকে জানাতে হবে। এরপর সালিশ পরিষদের মাধ্যমে পুনর্মিলনের চেষ্টা করা হবে। তিন মাসের মধ্যে যদি পুনর্মিলন না ঘটে, তবে তালাক কার্যকর হবে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে সমাজকর্মের বৈশিষ্ট 

৪. দেনমোহর প্রদান: আইন অনুসারে, স্ত্রী চাহিবা মাত্র স্বামীকে দেনমোহর প্রদান করতে বাধ্য করা হয়েছে। এই ধারা নারীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৫. ভরণপোষণের অধিকার: স্বামী যদি স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে স্ত্রী ইউনিয়ন পরিষদে লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে পারবে। সালিশ পরিষদের মাধ্যমে স্বামীকে তার দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করা হবে।

৬. গর্ভাবস্থায় তালাক নিষিদ্ধ: আইনে গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে তালাক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে সন্তান এবং মাতার সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

৭. বিবাহের জন্য নির্ধারিত বয়স: আইনে ছেলেদের জন্য বিবাহের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর এবং মেয়েদের জন্য ১৬ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এই বয়স যথাক্রমে ২১ এবং ১৮ বছরে উত্তীর্ণ করা হয়।

৮. উত্তরাধিকার: মুসলিম পারিবারিক আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার। এই আইন অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি মারা যায় এবং তার সন্তান minor থাকে, তাহলে সেই সন্তানের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দাবি করা যাবে।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের কার্যকারিতা:

এই আইনটি নারীদের অধিকার রক্ষা এবং সমাজে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। আইনটি নারীদের বিবাহ, তালাক, দেনমোহর এবং ভরণপোষণ সংক্রান্ত অধিকার রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এর ফলে, নারীরা তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং বৈধভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।

আরো পড়ুনঃ সমাজসেবা কাকে বলে? সমাজসেবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

উপসংহার: ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন নারীদের অধিকার রক্ষার একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি নারীদের বৈবাহিক জীবনের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ আইন পুরোপুরি কার্যকর করতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবুও, এ আইন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হিসেবে আজও প্রাসঙ্গিক।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263