মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকা: বাঙালির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ দুটি সমার্থক শব্দ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি স্বাধিকার ও রাজনৈতিক আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিটি আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে ত্বরান্বিত করেছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর হাত থেকে চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। এই আলোচনায় আমরা দেখব বঙ্গবন্ধু কিভাবে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন।
১. জাতীয়তাবাদের চেতনা সৃষ্টি এবং চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্য গঠন: বাঙালি জাতি দেশবিভাগের পরে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে ছিল. প্রায় দীর্ঘ ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর তাদের ওপর নেমে আসে আবার পাকিস্তানি বর্বরতার ছোঁয়া। ঠিক এমন সময় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালির রাখাল রাজা শেখ মুজিবুর রহমান এই জাতির হাল ধরেন। তিনি এই মধ্যে এই জাতির অভ্যন্তরে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ঐক্য গঠনের তাগিদ দেন এবং ঐক্য গঠনে দিকনির্দেশনা দিয়ে সহযোগিতা করেন।
২. ভাষা আন্দোলনের সূচনা: ভাষা প্রতিটি জাতির জন্য একটি অমূল্য সম্পদ।কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকেই আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলার উপর আক্রমণ শুরু করে. তারা আমাদের মুখের কথাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। বেতার এবং টেলিভিশনের প্রচারিত বাংলা ভাষার বিভিন্ন অনুষ্ঠান তারা বন্ধ করে দেয়। তাদের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে মজিবুর রহমান তার অন্যান্য রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে নিয়ে-মিছিল ধর্মঘট করলে পাকিস্তানের বাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করে এবং কারাগারে প্রেরণ করে. এই কারাবন্দীদের মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে রাজধানীতে হরতাল অবরোধ অব্যাহত থাকে।
আরো পড়ুনঃ দ্বি-জাতি’ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর
৩. জিন্নার ঘাষণা লঙ্ঘন করে ভাষার অধিকার আদায়: ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্না উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে বাঙালি ছাত্র সমাজ আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে. শেখ মুজিব জেলে থেকেই এই উদ্দীপ্ত ছাত্র সমাজকে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেন. যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে আসে এবং বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার আদায় করে নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কারাগারের মধ্যেও নিজের অবস্থান থেকে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তিনি আমরণ অনশন করেছিলেন সেখানে। তাই আমরা বলতে পারি আমাদের গৌরবময় যে ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন তা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া অসমাপ্ত।
৪. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও বঙ্গবন্ধু: বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের অনেক ঘটনার মধ্যে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন একজন তরুণ নেতা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যুক্তফ্রন্টের অন্যান্য নেতাদের সাথে তিনি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণ করেন। শেখ মুজিব বাংলার জনগণকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব, জনসম্পৃক্ততা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা নির্বাচনের ফলাফলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ৩০৯ টি আসনের মধ্যে ২২৮ টি আসনে জয়লাভ করে।
৫. বাঙালির ম্যাগনাকার্টা ও বঙ্গবন্ধু: এদেশের মানুষকে শোষণ, নিপীড়ণ ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার অবস্থান বুঝতে পারে এবং তার অধিকারের বিষয়ে আরও সোচ্চার হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের যাবতীয় কথা উল্লেখ ছিল। ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি থানা, মহকুমা, বৃহত্তর জেলা এবং বিভাগ পরিদর্শন করেন। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবী সকলকে তিনি ছয় দফার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেন। নিম্নে বর্ণিত ছয় দফার দাবিগুলো পর্যালোচনা করে আমরা তার দূরদর্শী চেতনা সম্পর্কে বুঝতে পারবো।
আরো পড়ুনঃ সামরিক শাসন বলতে কি বুঝ?
১. পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার গঠন করা। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠান।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুটি বিষয় থাকবে, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্যান্য সকল বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।
৩. সারাদেশে হয় অবাধে বিনিয়োগযোগ্য দু’ধরনের মুদ্রা, না হয় বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে একই ধরনের মুদ্রা প্রচলন করা।
৪. সকল প্রকার কর ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রাজস্বের একটা নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
৫. অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে, এর নির্ধারিত অংশ তারা কেন্দ্রকে দেবে।
৬. প্রাদেশিক নিরাপত্তার জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া।
৬. গণঅভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু: ১৯৬৬ সালের ৬ দফা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি 1969 সালে গণঅভ্যুত্থান ঘটায়। এই অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত ফলাফল হলো আইয়ুব খানের পতন. এই আন্দোলনে ছাত্ররা ১১ দফা দাবি উত্থাপন করেন যা ছয় দফা দাবির একটি বর্ধিত রূপ হিসেবে বিবেচ্য। তাই বলা যায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে সহযোগিতা করেছেন।
৭. ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততা: বাঙালি জাতি উপমহাদেশ বিভক্তির পর থেকেই একটি সাধারণ এবং সুস্পষ্ট নির্বাচনের প্রত্যাশা মনে পোষণ করত. কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার কখনো তার প্রতিফলন ঘটায় নি. অবশেষে ১৯৭০ সালে নানা টালবাহানার পরে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
৮. মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা প্রদান: শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭-ই মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতির মুক্তির রোড ম্যাপ বর্ণনা করেন। তিনি সবাইকে ঐক্যের আহ্বান জানান। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার তাগিদ দেন এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত দমে যেতে বারণ করেন। মূলত শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের এই রক্ত গরম করা বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ।
৯. স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠ: “এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।” বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় এবং যুদ্ধ শেষে আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হই ।
আরো পড়ুনঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো দুটো সেক্টর সম্পর্কে লিখ
১০. স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয়ভাবে সম্মুখে থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। কেননা ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন. এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ে চলে যায়. এর পরে যুদ্ধকালীন সময় তাকে আর ছেড়ে দেওয়া হয় না. কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শ নয় এবং অনুপ্রেরণামূলক দিকনির্দেশনায় বাঙালি জাতি অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ দিতে সমর্থ হয় ।
উপসংহার: পরিশেষে আমরা বলতে পারি বঙ্গবন্ধু নামটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘ ত্যাগ তিতিক্ষা এবং আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কাঙ্খিত বিজয় অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান তাকে পৃথিবীতে এখনও অমর করে রেখেচেছেন। তার এই অবদানগুলো বিশ্লেষণ করে বলতে পারি যদি বঙ্গবন্ধু না থাকতো তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কঠিন হয়ে যেত।