যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
ভূমিকা: আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা অন্যতম। এই ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত থাকে, যাতে উভয় সরকার নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। সংবিধানের মাধ্যমে উভয় স্তরের ক্ষমতা নির্ধারিত হয় এবং কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, এবং সুইজারল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। এই শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. দ্বৈত সরকার ব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দুটি পৃথক স্তরের সরকার থাকে: একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অপরটি প্রাদেশিক বা অঙ্গরাজ্য সরকার। উভয় সরকারই সংবিধান থেকে ক্ষমতা লাভ করে এবং তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
আরো পড়ুনঃ সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য
২. দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা: এই শাসনব্যবস্থায় সাধারণত দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা থাকে, যা দুইটি কক্ষে বিভক্ত। উচ্চকক্ষে সাধারণত প্রাদেশিক বা অঙ্গরাজ্য প্রতিনিধিত্ব থাকে এবং নিম্নকক্ষে থাকে জনগণের প্রতিনিধিত্ব। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের রাজ্যসভা এবং লোকসভা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসকে উল্লেখ করা যেতে পারে।
৩. ক্ষমতার বণ্টন: কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যে ক্ষমতার পরিষ্কার বিভাজন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রতিরক্ষা, মুদ্রা, এবং পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকে, আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং স্থানীয় সেবা প্রাদেশিক সরকারের অধীনে থাকে।
৪. সংবিধানের প্রাধান্য: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান উভয় সরকারের ক্ষমতার উৎস এবং তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। কেন্দ্র এবং প্রদেশগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে সংবিধানের ভিত্তিতে সেই বিরোধের সমাধান করা হয়।
৫. লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান: অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধান লিখিত এবং দুষ্পরিবর্তনীয়। এর ফলে কোনো সরকার সহজে সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান একটি লিখিত দলিল, যা খুব সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয়।
৬. দ্বি-নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৈশিষ্ট্য হলো দ্বি-নাগরিকত্ব। নাগরিকেরা একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের এবং প্রাদেশিক বা অঙ্গরাজ্যের নাগরিকত্ব ভোগ করেন। ফলে তারা উভয় স্তরের সরকারের কাছ থেকে অধিকার লাভ করেন এবং উভয় সরকারের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
৭. স্বায়ত্তশাসন: প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলো স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ভোগ করে। প্রতিটি প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্য নিজস্ব শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারে এবং তাদের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ সাধারণত হয় না।
আরো পড়ুনঃ গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য
৮. বিচার বিভাগের প্রাধান্য: সংবিধানের ধারাবাহিকতা ও কার্যকারিতা বজায় রাখতে বিচার বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগ সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার সংবিধানিক বিতর্ক নিরসন করে।
৯. সমমর্যাদা: প্রত্যেক প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্য সমান মর্যাদায় অধিকারী। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকেনা এবং সকল অঙ্গরাজ্য কেন্দ্রের নিকট সমানভাবে প্রতিফলিত হয়।
১০. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত: যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত কেন্দ্র এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করে। এটি কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোর মধ্যে যে কোনো ধরনের আইনি বিরোধ বা সংবিধান সম্পর্কিত বিতর্কের সমাধান করে।
১১. দ্বৈত আইন: যুক্তরাষ্ট্রে দুটি পর্যায়ে আইন প্রণীত হয়: কেন্দ্রীয় আইন এবং প্রাদেশিক আইন। কেন্দ্রীয় আইনসভা কেন্দ্রীয় বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে এবং প্রাদেশিক আইনসভা স্থানীয় বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে। নাগরিকদের উভয় স্তরের আইন মেনে চলতে হয়।
১২. দ্বৈত বিচার ব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক স্তরে পৃথক বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান। কেন্দ্রীয় আইনের জন্য কেন্দ্রীয় আদালত এবং প্রাদেশিক আইনের জন্য প্রাদেশিক আদালত কাজ করে।
১৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় মনোভাব: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় জনগণের মধ্যে একটি জাতীয় মনোভাব এবং স্থানীয় সত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় থাকে। এতে প্রাদেশিক সরকারগুলো যেমন কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, তেমনই তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থাও সংরক্ষিত থাকে।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট কী
উপসংহার: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা আধুনিক বিশ্বের অন্যতম কার্যকর ও সফল সরকার ব্যবস্থা। এর দ্বৈত সরকার ব্যবস্থা, সংবিধানের প্রাধান্য এবং স্বায়ত্তশাসনের ফলে এটি একটি শক্তিশালী ও সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রদান করে। বিভিন্ন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগণের অধিকার সংরক্ষণ করে এটি শাসনকার্যে গতি এবং স্থিতিশীলতা আনে।