ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম উক্তিটি ব্যাখ্যা কর

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকা: সার্বভৌমিকতার কথার অর্থ হল চূড়ান্ত অসীম ও অবাধ ক্ষমতা। আইনগত দিক থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কারণ সে যে কোন আইন তৈরি করতে পারে, সংশোধন করতে পারে এমনকি বাতিল করতে পারে। আদালত তার বৈধতা বিচার করতে পারেনা। এমনকি যদি কোন আইন ন্যায়-নীতির বিরোধী হয় তাহলে তার বিরোধিতা করা যাবে না। সরকারের শাসন বিভাগ কে পার্লামেন্টের তৈরি আইন মেনে কাজ করতে হয়। তা না করলে পার্লামেন্ট অনাস্থা প্রস্তাব এনে সরকারকে সরিয়ে দিতে পারে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম উক্তিটি ব্যাখ্যা করার জন্য যেসব বিষয় বিস্তারিত জানা প্রয়োজন তা ধারাবাহিকভাবে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের ভিত্তি: গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত। সুতরাং, লিখিত আইন অনুযায়ী। পার্লামেন্টের সার্বভৌম মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ব্রিটেনের শাসনতান্ত্রিক অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মতো পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বও হলো সুদীর্ঘকালের ক্রমবিকাশের ফল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন, সাংবিধানিক রীতিনীতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে।

পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব বলতে আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে পার্লামেন্টের নিরঙ্কুশ, অবাধ ও চরম ক্ষমতাকে বুঝায়, যা কোন ব্যক্তি আদালত এবং প্রতিষ্ঠান প্রণীত আইনের বৈধতা এবং সাংবিধানিকতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে না।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি: ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব আইনগত রাজনৈতিক নয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে কোন আইন প্রণয়ন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। আইনগত বিচারে পার্লামেন্টের ক্ষমতা অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যার হাতে আইন প্রণয়নের চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকে, আইনগত দিক থেকে সে ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ সার্বভৌম। ব্রিটেনের আইন প্রণয়নকারী একমাত্র সংস্থা হলো পার্লামেন্ট। সুতরাং, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাতে আইনগত সার্বভৌমত্ব ন্যস্ত আছে।

আরো পড়ুনঃ বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা কেন মান্য করা হয়?

Prof. Dicey এর মতে, “ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিরঙ্কুশ আইনগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।” তিনি এ সম্পর্কে তিনটি মন্তব্য করেছেন। যথা:

১. ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে।

২. পূর্বে প্রণীত যে কোন আইনকে সংশোধন বা বাতিল করতে পারে এবং

৩. শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে পারে।

আরো দুটি বিষয় থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যথা ও প্রথমত, যুক্তরাজ্যে সাংবিধানিক আইন এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য নিরূপণ করা হয় না। এখানে পার্লামেন্টের আইনই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। দ্বিতীয়ত, রাজা বা রানীর ডোমিনিয়নগুলোর ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতা প্রযুক্ত হয়।

পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে নিম্নলিখিত মতগুলো প্রতিষ্ঠা করা যায়:

১. পার্লামেন্টের ক্ষমতার উপর আদালতের এক্তিয়ার নেই: ব্রিটেনে আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের ক্ষমতাই চরম ও চূড়ান্ত। মার্কিন বিচার বিভাগের মতো ব্রিটেনের বিচার বিভাগ আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের বৈধতা বিচার করতে পারে না। আবার আদালতের কোন সিদ্ধান্ত ইচ্ছা করলে নাকচ করে দিতে পারে না। 

২. শাসন বিভাগের কোন এক্তিয়ার নেই: বর্তমানে রাজা বা রানীর ভূমিকা আনুষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক। সুতরাং, শাসন বিভাগের দিক থেকে পার্লামেন্টের আইনগত ক্ষমতার উপর কোন বাধা নেই। Black Stone এর মতে, “ব্রিটেনের পার্লামেন্টের কাজকে অগ্রাহ্য করতে পারে এমন কোন শক্তি ইহজগতে নেই।”

৩. কার্যকাল বৃদ্ধি: পার্লামেন্ট তার কার্যকালের মেয়াদ বাড়াতে পারে। কার্যক্ষেত্রে পার্লামেন্ট বহুবার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। যেমন- ১৬৯৪ সালে প্রণীত ‘ত্রিবার্ষিক আইন’ এর মাধ্যমে পার্লামেন্ট নিজের কার্যকাল ৩ বছর নির্দিষ্ট করেছে। তারপর ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে ‘সপ্তবার্ষিক আইন’ অনুসারে পার্লামেন্টের মেয়াদ ৩ বছর থেকে ৭ বছরে উন্নীত করা হয়েছে। 

৪. শাসনব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তার সার্বভৌম ক্ষমতার বলে আইনের মাধ্যমে দেশের শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, “Act of Settlement, Act of Union Ges-Reform Bill” উল্লেখযোগ্য। 

আরো পড়ুনঃ ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের পটভূমি

৫. বৈদেশিক ক্ষমতা: বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষে ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।

৬. দণ্ড নিষ্কৃতি আইন পাস করতে পারে: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট Indeminity Act’ বা দত্ত নিষ্কৃতি আইন পাস করে অতীতের অবৈধ কাজকে বৈধ বলে স্বীকার করতে পারে। শাসন বিভাগ যুদ্ধকালে যেসব অবৈধ কাজ সম্পাদন করে এ আইন পাস করে পার্লামেন্ট সেগুলোকে বৈধ ঘোষণা করে থাকে।

৭. আন্তর্জাতিক আইন ও পার্লামেন্টের প্রাধান্য: পার্লামেন্ট প্রণীত আইন আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃত নীতিগুলো মেনে চলে কি না এ প্রশ্ন ব্রিটিশ আদালতের নিকট অবান্তর। পার্লামেন্ট আইন করছে এটি তাদের (আদালতের) কাছে যথেষ্ট। এছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য:

১. ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত সে কারণে অন্যান্য সংবিধানের ন্যায় এখানে পার্লামেন্টের ক্ষমতা নির্দিষ্ট নয়।

২. ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা এককেন্দ্রিক। সুতরাং, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।

৩. ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব বলতে প্রধানত কমন্স সভার সার্বভৌম ক্ষমতাকে বুঝায়। জনগণের প্রতিনিধিপুষ্ট গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিটেনে কমন্স সভারই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৪. ব্রিটেনে পার্লামেন্ট প্রণীত আইন ও শাসনতান্ত্রিক আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

৫. ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব রাজা বা রানীর ডোমিনিয়নগুলোর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

পার্লামেন্টের সীমাবদ্ধতা: আইনগত দিক থেকে পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত কিন্তু বাস্তবে এর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিভিন্নভাবে সীমাবদ্ধ। যথা:

১. জনমতের নিয়ন্ত্রণ: তত্ত্বগতভাবে পার্লামেন্ট যে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে পার্লামেন্ট কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না।

২. প্রথা-রীতিনীতির গুরুত্ব: ব্রিটেনের শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো হলো সুদীর্ঘকালের সংগ্রাম ও দীর্ঘকালীন শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিবর্তনের ফল। এগুলোর প্রতি জনগণের আনুগত্য অপরিসীম। তাই পার্লামেন্ট এগুলোকে উপেক্ষা করে আইন তৈরি করতে পারে না।

৩. কেবিনেট প্রথা: বর্তমানে ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় কেবিনেট পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে পার্লামেন্ট কেবিনেটকে

নয়। ফলে কেলিনেটের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাস্তবে পার্লামেন্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। 

৪. আহ্বল টক আইনের নিয়ন্ত্রণ: বর্তমানে দুনিয়ার সকল সভ্য রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ব্রিটেনেও এর বাতিক্রম নয়। তাই আন্তর্জাতিক আইনের গণ্ডির মধ্যে থেকেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে কাজ করতে হয়।

৫. ওয়েস্ট সিস্টার আইন ১৯৩১ সালে ওয়েস্ট মিনিস্টার আইন প্রণীত হওয়ার ফলে কোন ডোমিনিয়নের মতামত ছাড়া পার্লামেন্ট তার জন্য কোন আইন তৈরি করতে পারে না।

আরো পড়ুনঃ নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

৬. রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের নিয়ন্ত্রণ: ব্রিটেনের জনসাধারণ হলো রাজনৈতিক সার্বভৌম। সুতরাং, রাজনৈতিক

সার্বভৌমত্বকে একেবারে উপেক্ষা করে পার্লামেন্ট কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না।

৭. আদালতের আংশিক নিয়ন্ত্রণ: আদালত আইন ব্যাখ্যার মাধ্যমে পার্লামেন্টের উপর আংশিকভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে।

৮. স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোন আইন প্রণয়ন করতে গেলে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মতামত নিতে হয়। যদিও এর কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, তথাপি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবকে পার্লামেন্ট সবসময় কাটিয়ে উঠতে পারে না।

৯. অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ: ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের উপর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ আরোপিত। আইন প্রণয়নের প্রাক্কালে পার্লামেন্টের সদস্যা তাদের আর্থসামাজিক পরিবেশ, জাতিগত ঐতিহ্য, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতি অলক্ষ্য প্রভাবকে কখনই কাটিয়ে উঠতে পারে না।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আইনগত দিক থেকে সার্বভৌম হলেও তা অনেক তত্ত্বসর্বস্ব। কারণ ক্ষমতা কার্যত কেবিনেটের নির্দেশ অনুসারেই প্রয়োগ করা হয়। মূলত দিন দিন কেবিনেটের ক্ষমতা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পার্লামেন্টের ক্ষমতা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে।

কেবিনেটের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই পার্লামেন্টের পক্ষে পুরানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়া সম্ভব। সুতরাং ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম কথাটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263