বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে টীকা লেখ।
ভূমিকা: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও তখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। এই মহান নেতার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলেও তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল, কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি জাতির কাছে ছিল একটি অপূর্ণতা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল সেই অপূর্ণতার সমাপ্তি। তাঁর স্বদেশে ফেরার দিনটি বাঙালি জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পটভূমি:
স্বাধীনতার পরের সময়টি ছিল অত্যন্ত অস্থির এবং সংঘাতময়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যখন বুঝতে পারল তারা আর পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তখন তারা শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু শেখ মুজিব তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চাপের মুখে পড়েন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং লন্ডনে আগমন:
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর তাঁকে পাকিস্তান থেকে একটি পিআইএ বিমানে করে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডনে তিনি সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং একটি প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য দেন। লন্ডনে একদিন থাকার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ‘কমেট’ নামক একটি বিমানে করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
আরো পড়ুনঃ জলবায়ু পরিবর্তন বলতে কী বোঝায়?
দিল্লিতে সংবর্ধনা:
লন্ডন থেকে রওনা হওয়ার পথে বঙ্গবন্ধুর বিমান ভারতের দিল্লিতে অবতরণ করে। এখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রেসিডেন্ট ভি.ভি. গিরি তাঁকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধু ভারতের জনগণ এবং নেতাদের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। দিল্লিতে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানান। তারপর তিনি তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার জন্য রওনা হন।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন:
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, দুপুর ১.৪২ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় ভিড় জমায়। মানুষ তাকে দেখতে এবং স্বাগত জানাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তটি বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকে।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহম্মদ তাঁর স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন, তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত মাত্র ৪ মাইল পথ অতিক্রম করতে বঙ্গবন্ধুর প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়, তাঁদের উল্লাস এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এদিনের দৃশ্যকে অনন্য এবং ঐতিহাসিক করে তোলে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য:
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য বাঙালি জাতির জন্য অপরিসীম। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন তা ছিল জাতির জন্য এক পরিপূর্ণতার মুহূর্ত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, আর তাঁর ফিরে আসা ছিল সেই স্বাধীনতার বিজয়ের পরিপূর্ণতা।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ার পথে অগ্রসর করে। তিনি দেশে ফিরে এসেই নতুন রাষ্ট্রের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়।
আরো পড়ুনঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো দুটো সেক্টর সম্পর্কে লিখ
উপসংহার: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক মহান অধ্যায়। তাঁর কারামুক্তি এবং দেশে ফিরে আসা জাতির জন্য এক নতুন সূচনা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ছিল সেই দিন, যেদিন জাতি তাঁর প্রিয় নেতাকে ফিরে পায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে এবং তাঁর ফিরে আসার মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠনের পথে যাত্রা শুরু করে।