জলবায়ু পরিবর্তন বলতে কী বোঝায়?
জলবায়ু পরিবর্তন বলতে পৃথিবীর আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনকে বোঝায়। কোনো একটি স্থানের জলবায়ু বলতে সেখানে বছরের পর বছর ধরে যে আবহাওয়ার গড় অবস্থান, তাকে বুঝানো হয়। যখন সেই স্থানে আবহাওয়ার স্বাভাবিক ধরন বদলে যায়, তখন তাকে জলবায়ু পরিবর্তন বলা হয়। বর্তমান সময়ে পৃথিবী উষ্ণায়নের (global warming) ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন দ্রুত ঘটছে। এর ফলে বহুদিনের চেনাজানা আবহাওয়ার আচরণ বদলে যাচ্ছে, যা প্রাকৃতিক পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ:
জলবায়ুর পরিবর্তনের পিছনে মূলত দুটি ধরনের কারণ থাকে— প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট।
১. প্রাকৃতিক কারণ: বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা যেমন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, সূর্যের বিকিরণ প্রভাব, মহাজাগতিক বস্তুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ ইত্যাদি জলবায়ুর প্রাকৃতিক পরিবর্তনের পেছনে থাকে।
২. মানবসৃষ্ট কারণ: বর্তমান সময়ে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হল মানুষের বিভিন্ন কার্যক্রম। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন। যখন মানুষ তেল, গ্যাস, এবং কয়লা পোড়ায়, তখন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ায়, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও বন ধ্বংস, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়া জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ।
আরো পড়ুনঃ মানব ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব:
১. মানুষের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের জীবনযাপনে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে পানির সংকট দেখা দেবে, খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে অনেক অঞ্চল বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের মতো নিচু এলাকা প্লাবিত হবে, এবং অনেক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে।
২. চরম আবহাওয়া: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিরিক্ত গরম, ঝড়, বৃষ্টি এবং খরা বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে এসব চরম আবহাওয়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে। কারণ এসব দেশ চরম আবহাওয়া মোকাবিলার সক্ষমতা কম থাকে।
৩. পরিবেশের উপর প্রভাব: তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। এতে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে, যা উপকূলীয় এলাকাগুলোর জন্য হুমকি তৈরি করছে। এছাড়া জমাট বাধা বরফ গলে মিথেন গ্যাস মুক্ত হওয়ার কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ আরও বেড়ে যাচ্ছে। এইসব কারণে বিশ্বব্যাপী বনাঞ্চলের ধ্বংসের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. বিলুপ্তির সম্ভাবনা: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক প্রাণী তাদের আবাসস্থল পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন এত দ্রুত হচ্ছে যে অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ছে। যেমন, মেরু অঞ্চলের শ্বেত ভালুক বা পোলার বিয়ারদের জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া ট্রপিক্যাল অঞ্চলের কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীরগুলো ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব:
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশ এবং প্রাণিজগতের উপরেই নয়, মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উপরেও গভীর প্রভাব ফেলছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ ও মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাস্থ্য সমস্যা, ক্ষুধা, গৃহহীনতা, এবং কর্মসংস্থানের সংকট দেখা দেবে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী অভিবাসনের চাপও বাড়বে। অনেক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে স্থানচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়াতে পারে। এর ফলে বৈশ্বিকভাবে মানবিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরো পড়ুনঃ নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা
উপসংহার: জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এর প্রভাব ইতিমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দৃশ্যমান হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং মানবসৃষ্ট কারণগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিণতি দেখা দিতে পারে। অতএব, সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে একসাথে কাজ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হতে হবে।