বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি আলোচনা কর।
ভূমিকা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার প্রত্যাশিত লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। তাই নিজেদের অধিকারকে ছিনিয়ে আনার জন্য, দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীন করার জন্য ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ’ আমাদের সামাজিক জীবনে এক দীপালি সংযোজন । এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দখল করে নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ও
রাজনৈতিক পটভূমি: বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। নিম্নে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি আলোচনা করা হলো:
১. বাঙালির দাবি: একটি স্বাধীন বাংলাদেশ বাঙালিদের অনেক দিনের দাবি। তাই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যখন ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্ত হয় তখন ঙালি জাতি পূর্ব বাংলাকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দাবি করে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ্যের জন্য বাঙালির এ ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করতে থাকে এবং ঔপনিবেশিক মনোভাব নিয়ে বাঙালিদের উপর শাসন শোষণ চালাতে থাকে ।
আরো পড়ুনঃ জলবায়ু পরিবর্তন বলতে কী বোঝায়?
২. ভাষা আন্দোলন: ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সর্বপ্রথম বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে বাঙালিরা তাদের হীন চক্রান্ত বুঝতে পারে। বাঙালি তাদের মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের সব বেড়াজাল ছিন করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে তাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করে। এখান থেকেই এদেশের মানুষ দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দীক্ষা পায় যা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা যোগায়।
৩. আওয়ামী লীগ গঠন: ভাষা আন্দোলনের সফলতা পূর্ব বাংলার জনমনে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করে। তাই মুসলিম লীগের মেরুদণ্ডবিহীন কার্যকলাপ এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ও সামন্ত প্রভুদের কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ গঠন করে যা স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকনির্দেশনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
৪. যুক্তফ্রন্ট গঠন: অধিকার সচেতন এদেশের মানুষ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সম্মিলিত যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। একুশ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে। বাঙালিদের এ বিজয়কে পাকিস্তানি শাসক চক্র সহজে মেনে নিতে পারেনি।
৫. শাসগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র: পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাতে থাকে বাঙালি-অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে এদেশের সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ১৯৫৫ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে অনেক নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করে।
৬. কাশ্মীর যুদ্ধ: ১৯৬৫ সালের কাশ্মীর যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকরা তাদের শৌর্যবীর্যের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। যুদ্ধের সময়ে পূর্ব বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। দেশে খাদ্যসংকট দেখা দেয়, দেশ সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য সরকার এ দেশবাসীর উপর ট্যাক্সের মোটা বোঝা চাপিয়ে দেয়।
৭. সামরিক অভ্যুত্থান: ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অন্যতম কারণ। ১৯৫৮ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে নেয়। ক্ষমতা দখলের পর থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সামরিক কায়দায় এদেশের মানুষের উপর নির্যাতন চলতে থাকে। তাই জনগণ মুক্তির জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে।
আরো পড়ুনঃ ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণসমূহ
৮. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে যেসব বিষয় ও ঘটনা ত্বরান্বিত করেছে তন্মধ্যে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান অন্যতম। ১৯৬৯ সালে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে ১১ দফা দাবিকে সামনে নিয়ে ছাত্র জনতার এক গণঅভ্যুত্থান ঘটে । ছাত্র শিক্ষকের রক্তে ভেজা এ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
৯. অর্থনৈতিক বৈষম্য: পাক-ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় আয়ের শতকরা ৫২ ভাগই ছিল পূর্ব বাংলার অবদান। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এদেশের উৎপাদিত কাঁচামাল সেখানে নিয়ে সেখানকার শিল্পজাত দ্রব্য এদেশে রপ্তানি করে। এতে ব্যাংক, বিমা, শিল্পকারখানা, ব্যবসায় বাণিজ্য এককভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। পূর্ব পাকিস্তানিরা হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাঁচামালের যোগানদাতা।
১০. শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য: এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিও পাকিস্তানিরা চরম বৈষম্য সৃষ্টি করে। এখানকার তুলনায় সে দেশে শিক্ষা সামগ্রীর সহজলভ্যতা এর বড় প্রমাণ।
১১. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শাসকগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে এদেশের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে থাকে। তারা এদেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করে। এমনকি কাশ্মীর যুদ্ধের পর এদেশের বেতারে রবীন্দ্র সংগীতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১২. জাতীয় পরিষদ স্থানান্তর: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের অভূতপূর্ব সাফল্যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হারাবার ভয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকা থেকে রাওয়াল পিণ্ডিতে স্থানান্তর করতে সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকার বিভিন্ন অফিসে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরিবেশকে অশান্ত করে তোলে এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে।
১৩. মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ: সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে নরপিশাচ ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে সামরিক জান্তা এদেশের স্বাধীনচেতা জনগণের আন্দোলনকে দমানোর জন্য শতাব্দীর সেরা বর্বরোচিত নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ভয়ঙ্কর মৃত পুরীতে দেশকে পরিণত করে। কিন্তু যাদের রক্ত স্বাধীনতার জন্য টগবগ করছে সেই জনগণও বসে থাকেনি। তারা ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে।
১৪. বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
১৫. অর্থনৈতিক কারণ: পশ্চিমা শাসন ও শোষণের ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়। এক হিসাব অনুযায়ী ১৯৪৮-৬৯ সালে মধ্যে ৪১৯ কোটি টাকার সম্পদ পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হয়। আবার ১৯৫০-৬৯ সালের মধ্যে পাকিস্তান যে ৫,৬৮৩ ডলার সাহায্য লাভ করে তার মধ্যে ৩৪% পূর্বপাকিস্তানকে দেয়া হয়। এসব কারণে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম পরিচিতি বিগত সালের কোশ্চেন
উপসংহার: পরিশেষে আমরা বলতে পারি, যেসব আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক শোষণের স্বীকার হয়ে বাঙালি জাতি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মধ্যে ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয়দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন অন্যতম। তাই বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি অতি দীর্ঘ। সুদীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বীর বাঙালি তাদের প্রত্যাশিত স্বাধীনতা লাভ করে।