আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কী?
ভূমিকা: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই মামলাটি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ধাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এবং সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে, যা “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে পরিচিত। এই মামলার মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে কোণঠাসা করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাঙালি জাতির সংগ্রামী চেতনা আরও দৃঢ়ভাবে ফুটে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধীনতার আন্দোলনের জন্য সংগঠিত করে তোলে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পটভূমি:
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নানা ধরনের শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছিল। ভাষা, অর্থনীতি, রাজনীতি সবক্ষেত্রেই বৈষম্য ছিল প্রকট।
আরো পড়ুনঃ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে শাসন চালিয়ে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দমন করার নীতি গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায় এবং শোষণ থেকে মুক্তির জন্য তখনকার নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার পরিকল্পনা করতে থাকেন। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সঙ্গীরা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য একটি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করেন, যার ভিত্তিতে পাকিস্তান সরকার তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কী?
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল পাকিস্তান সরকারের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি মামলা। অভিযোগ ছিল যে, তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এবং ভারতের আগরতলায় গিয়ে পাকিস্তানবিরোধী ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাই এই মামলাটির নামকরণ করা হয় “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা”।
১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে মামলা করা হয় এবং ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে এই মামলা প্রকাশ্যে আসে। শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও যেসব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন নৌবাহিনীর অফিসার লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম এবং আরও অনেক সামরিক কর্মকর্তা।
মামলার মূল অভিযোগ:
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধানত তিনটি অভিযোগ ছিল:
১. শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করার পরিকল্পনা করছিলেন।
আরো পড়ুনঃ বাংলা নামের উৎপত্তি
2. ভারতের আগরতলায় গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সঙ্গীরা ভারতের সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।
3. পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার চেষ্টা করছিলেন তারা।
মামলার প্রক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া:
এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে সামরিক আদালতে বিচার শুরু করা হয়। মামলা শুরু হলে দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে “শেখ মুজিব মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয় এবং ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হত্যার ঘটনায় এই আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
বাঙালি ছাত্রসমাজের এই আন্দোলনটি পরে গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং তৎকালীন সামরিক সরকারকে চাপে ফেলে। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, তীব্র জনমতের চাপে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দেওয়া হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রভাব ও তাৎপর্য:
স্বাধীনতার আন্দোলনের উন্মেষ: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। এই মামলার মাধ্যমে বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রে থাকার মাধ্যমে তাদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা: এই মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। মামলার কারণে তিনি বাঙালি জনগণের সমর্থন লাভ করেন এবং তাদের একমাত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। পরবর্তীতে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
গণ-অভ্যুত্থান এবং আইয়ুব খানের পতন: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মামলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং ছাত্রসমাজ ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং গণআন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের চাপে পড়ে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।
আরো পড়ুনঃ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে টীকা
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। বাঙালিরা বুঝতে পারে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে তাদেরকে নিজেদের অধিকার আদায় করতে হবে।
উপসংহার: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য ধাপ। এ মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং বাঙালিরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রভাবই পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পথ তৈরি করে।