৬ দফা আন্দোলন কি? 

৬ দফা আন্দোলন কি? 

ভূমিকা: ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এ আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে প্রণীত হয়েছিল। বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রাথমিক রূপরেখা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়টি দাবি উত্থাপন করেন, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া।

৬-দফা আন্দোলনের পটভূমি:

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল – পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত ছিল এবং বাঙালিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শোষণ করছিল, আর এ শোষণ এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্রমশ বাঙালিরা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছিল। এরই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয়টি দাবির ভিত্তিতে একটি আন্দোলন শুরু করেন, যা “ছয় দফা আন্দোলন” নামে পরিচিত।

৬-দফার দাবি সমূহ:

৬-দফা আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। ছয়টি দাবি ছিল নিম্নরূপ:

১. যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা: প্রথম দাবিটি ছিল পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে প্রাদেশিক সরকারগুলো পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে, বাকি সবকিছু প্রাদেশিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে।

আরো পড়ুনঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো দুটো সেক্টর সম্পর্কে লিখ

২. প্রদেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: দ্বিতীয় দাবিতে প্রাদেশিক সরকারগুলোকে নিজেদের আয়-ব্যয়ের স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হয়। এই দফায় বলা হয়, প্রদেশগুলো তাদের নিজস্ব আয়ের উৎসের উপর নির্ভর করবে এবং তারা নিজেদের সম্পদের ব্যবহারে স্বাধীন হবে।

৩. মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা: তৃতীয় দফায় প্রাদেশিক সরকারের নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের অধিকার চাওয়া হয়। এছাড়া, যদি একই মুদ্রা চালু থাকে, তাহলে এর কার্যকারিতা কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সুনির্দিষ্ট শর্তে থাকবে।

৪. আয়কর ও রাজস্ব আদায়ের স্বাধীনতা: চতুর্থ দাবিতে বলা হয়, প্রদেশগুলো আয়কর এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখবে এবং আঞ্চলিক আয় থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেবে।

৫. বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ: পঞ্চম দফায় প্রাদেশিক সরকারের হাতে নিজস্ব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকা উচিত বলে দাবি করা হয়। এখানে প্রাদেশিক সরকারের অধীনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়।

৬. আধা সামরিক বাহিনী গঠন: শেষ দাবিতে প্রাদেশিক সরকারগুলোর নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠনের অধিকার নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া, প্রদেশগুলোকে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়ার কথাও বলা হয়।

৬-দফা আন্দোলনের তাৎপর্য:

৬-দফা আন্দোলন বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের পথে এক মাইলফলক। এটি ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এটি ছিল প্রথম সার্বিক প্রতিবাদ এবং এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়।

৬-দফা আন্দোলনের প্রভাব:

১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: ৬-দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। এই আন্দোলনের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।

২. গণঅভ্যুত্থানের সূচনা: ৬-দফার দাবিগুলো পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির অসন্তোষকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান ঘটে, যা আইয়ুব খানের শাসনের পতন ঘটায়।

আরো পড়ুনঃ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে টীকা

৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি: ৬-দফা আন্দোলনের দাবিগুলোই পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬-দফার ভিত্তিতেই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে।

৪. বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: ৬-দফা আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে একজন জাতীয় নেতায় পরিণত হন। তিনি ধীরে ধীরে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠেন।

উপসংহার: ৬-দফা আন্দোলন বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এটি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মসচেতনতার প্রথম প্রকাশ। ছয় দফার দাবিগুলোই পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252