উগ্র জাতীয়তাবাদ কী?

উগ্র জাতীয়তাবাদ কী?

ভূমিকাঃ জাতীয়তাবাদ হলো একটি রাজনৈতিক আদর্শ যা নিজের জাতি ও দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং ঐক্য প্রদর্শন করে। তবে এর একটি চরম রূপও রয়েছে, যা ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ নামে পরিচিত। উগ্র জাতীয়তাবাদ এমন এক ধরনের জাতীয়তাবাদ যা একটি নির্দিষ্ট জাতির শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় বিশ্বাস করে এবং অন্য জাতি বা জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা প্রকাশ করে। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা মনে করে তাদের জাতি অন্য সকল জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ, এবং তাদের জাতির স্বার্থ সবার আগে। এই শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা থেকে অনেক সময় তারা সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে চায়।

উগ্র জাতীয়তাবাদ কী?

উগ্র জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয়তাবাদের বিকৃত ও চরম রূপ, যা একজাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্য জাতির প্রতি বৈষম্য ও শত্রুতা তৈরি করে। এ ধরণের জাতীয়তাবাদে ব্যক্তি নিজের জাতিকে পৃথিবীর অন্যান্য জাতি থেকে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠ মনে করে, এবং সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে প্রস্তুত থাকে। এর মধ্যে অনেক সময় সহিংসতা, বিদ্বেষ, এবং যুদ্ধের মতো চরমপন্থী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র এক জাতিকে অন্যান্য জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি অন্য জাতি বা গোষ্ঠীগুলোর অধিকার ও স্বার্থকে উপেক্ষা করে এবং তাদের প্রতি বৈষম্য ও অত্যাচার করতে উৎসাহিত করে।

আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ

উগ্র জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ:

১. জাতীয়তাবাদের তীব্র আবেগ: উগ্র জাতীয়তাবাদীরা জাতির প্রতি চরম আবেগ প্রকাশ করে এবং অন্য জাতি বা জনগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র শত্রুতা পোষণ করে।

২. জাতীয় স্বার্থের প্রাধান্য: উগ্র জাতীয়তাবাদে নিজের জাতির স্বার্থ সবার উপরে রাখা হয়। এই স্বার্থ রক্ষা করার জন্য যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সঠিক মনে করা হয়, এমনকি তা যদি বৈষম্য বা সহিংসতার মাধ্যমে হয় তাও।

৩. বিদ্বেষ ও ঘৃণার প্রকাশ: উগ্র জাতীয়তাবাদীরা অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রকাশ করে। তারা মনে করে যে তাদের জাতি শ্রেষ্ঠ এবং অন্য সকল জাতি নিম্নস্তরের। এই ধারণা থেকেই বিদ্বেষ ও ঘৃণার জন্ম হয়।

৪. সহিংসতার প্রবণতা: উগ্র জাতীয়তাবাদীরা প্রায়ই সহিংসতা এবং যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে। তারা সহিংস পন্থা অবলম্বন করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? 

উগ্র জাতীয়তাবাদের ইতিহাস:

উগ্র জাতীয়তাবাদের অনেক উদাহরণ রয়েছে ইতিহাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। নাৎসিরা তাদের জাতিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ঘোষণা করে এবং ইহুদি, জিপসি, কমিউনিস্টসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের প্রতি নিপীড়ন চালায়। তারা ইহুদিদের গণহত্যা করে এবং এই ঘটনাটি ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। এই সময়ের উগ্র জাতীয়তাবাদ শুধু জার্মানিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা সমগ্র ইউরোপকে যুদ্ধ এবং ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

আধুনিক বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের কিছু রাজনৈতিক দল এবং নেতা জাতীয়তাবাদের নামে উগ্রপন্থী মতাদর্শ প্রচার করে, যা দেশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগণের প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতা সৃষ্টি করছে।

উগ্র জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক প্রভাব:

১. সহিংসতা ও বৈষম্য: উগ্র জাতীয়তাবাদীরা প্রায়ই সহিংসতার মাধ্যমে তাদের জাতির স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। তাদের এই সহিংসতা অনেক সময় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নের রূপ নেয়।

২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধ: উগ্র জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। জাতিগত বিদ্বেষ ও বৈষম্যের কারণে এক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররোচনা দেয়।

৩. গণতন্ত্রের বিপন্নতা: উগ্র জাতীয়তাবাদ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা প্রায়ই কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার পক্ষে থাকে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।

৪. যুদ্ধ ও সামাজিক বিভাজন: উগ্র জাতীয়তাবাদ সমাজের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি সমাজে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বৈষম্য তৈরি করে, যার ফলে মানুষ একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠে।

উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রতিরোধের উপায়:

উগ্র জাতীয়তাবাদের বিস্তার রোধ করা সহজ নয়, তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিছু কার্যকর পদক্ষেপ হলো:

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা

১. শিক্ষার প্রসার: শিক্ষা উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে বৈচিত্র্য, সহনশীলতা এবং একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতা গড়ে তোলা সম্ভব। জাতিগত বিদ্বেষ দূরীকরণে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

২. গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা: গণমাধ্যম উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচারণা রোধ করতে পারে। সঠিক তথ্য ও সমন্বিত প্রচারের মাধ্যমে সমাজকে এই ধরনের মতাদর্শের বিরুদ্ধে সচেতন করা সম্ভব।

৩. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা: উগ্র জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া জরুরি। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উগ্র জাতীয়তাবাদী সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪. ধর্মীয় শিক্ষার ভূমিকা: কোনো ধর্মই উগ্র জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে না। প্রতিটি ধর্মই মানুষের প্রতি সম্মান, সহনশীলতা, এবং ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। ধর্মীয় অনুশাসনের যথাযথ চর্চার মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিস্তার রোধ করা সম্ভব।

৫. অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা: উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রতিরোধে রাষ্ট্রকে এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। এই ধরনের ব্যবস্থা উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তৎপরতাকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

উপসংহার: উগ্র জাতীয়তাবাদ একটি বিপজ্জনক এবং বিভাজনমূলক মতাদর্শ। এটি মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ, সহিংসতা এবং সামাজিক বিভেদ সৃষ্টি করে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ কেবল দেশ এবং সমাজের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং বিশ্ব শান্তি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষা, গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা, এবং ধর্মীয় অনুশাসনকে ব্যবহার করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সমাজের সকল স্তরে এর বিস্তার রোধ করা অত্যন্ত জরুরি।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252