রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা
ভূমিকা: রাষ্ট্র হলো মানবসমাজের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংগঠন, যা সমাজে শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন কার্যাবলি পরিচালনা করে। মানুষ রাজনৈতিক জীব, এবং মানুষের জীবন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং নৈতিক কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে চলে। এরিস্টটলের মতে, মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। রাষ্ট্র মানবজীবনের অপরিহার্য অংশ, এবং এর অস্তিত্বের জন্য নির্দিষ্ট কিছু উপাদান অপরিহার্য।
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা: রাষ্ট্র এমন এক সংগঠিত জনসমাজ, যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য একটি সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং সার্বভৌমত্বের অধিকারী।
আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস এর মতে, “একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টিই হল রাষ্ট্র।”
বুন্টসলি এর মতে, “কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমাজই রাষ্ট্র।”
রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ: রাষ্ট্রের উপাদানগুলোকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—
১. মুখ্য উপাদান
২. গৌণ উপাদান
ক. মুখ্য উপাদান (Vital Elements): রাষ্ট্রের চারটি মুখ্য উপাদান রয়েছে। এই উপাদানগুলোর যেকোনো একটির অভাবে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।
১. জনসমষ্টি (Population): রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জনসমষ্টি। জনসংখ্যা ছাড়া রাষ্ট্রের ধারণা অসম্ভব। জনবসতিহীন অঞ্চল রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় না। জনগণই রাষ্ট্রের ভিত্তি, এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা, জীবনধারা, এবং ঐতিহ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্রের জনসংখ্যা নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা দ্বারা নির্ধারিত নয়; তা কয়েক হাজার থেকে কয়েক কোটি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের জনসংখ্যা প্রায় ১.৩ বিলিয়ন, আর ভ্যাটিকান সিটির জনসংখ্যা মাত্র ৭৭৮ জন।
২. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড (Territory): রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। একটি রাষ্ট্রকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করতে হবে। ভূখণ্ড বলতে শুধু মাটির উপরিভাগ নয়, মাটির নিচের সম্পদ, জলাভূমি এবং সমুদ্রসীমাও অন্তর্ভুক্ত। একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত ভূখণ্ড ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
৩. সরকার (Government): রাষ্ট্র গঠনের আরেকটি অপরিহার্য উপাদান হলো সরকার। সরকার হলো রাষ্ট্রের পরিচালনাকারী যন্ত্র। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কার্যক্রম পরিচালিত হয়, এবং রাষ্ট্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। অধ্যাপক গেটেল বলেন, “সরকার হলো রাষ্ট্রের একটি সংস্থা বা যন্ত্র।” সরকার ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এটি রাষ্ট্রের ইচ্ছাশক্তি প্রকাশ করে এবং জনগণের শাসন নিশ্চিত করে।
আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব
৪. সার্বভৌমত্ব (Sovereignty): সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত, অবাধ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোনো অঞ্চলকে রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। একটি রাষ্ট্রকে অন্য কোনো শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে স্বাধীনভাবে শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার রয়েছে, কিন্তু তারা সার্বভৌম নয়, তাই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত নয়।
খ. গৌণ উপাদান (Auxiliary Elements)
১. স্থায়িত্ব (Permanence): রাষ্ট্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। সরকারের পরিবর্তন হতে পারে, তবে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অপরিবর্তিত থাকে। এটির একটি দীর্ঘমেয়াদী গঠন আছে, যা সময়ের সঙ্গে স্থায়ী থাকে।
২. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি (Recognition): রাষ্ট্রের বৈশ্বিক পরিচিতি নিশ্চিত করতে তাকে অন্য রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে হয়। বিশেষত, জাতিসংঘের স্বীকৃতি রাষ্ট্রকে একটি বৈশ্বিক পর্যায়ে স্বীকৃতি প্রদান করে।
৩. সাম্য (Equality): আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বড় বা ছোট যাই হোক না কেন, স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সমান অধিকার এবং প্রভাব থাকে।
৪. পূর্ণ স্বাধীনতা (Full Independence): আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোকে স্বাধীনভাবে তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি বা সন্ধি করতে সক্ষম হতে হয়। স্বাধীনতা ছাড়া রাষ্ট্রের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয় না।
আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
উপসংহার: রাষ্ট্র হলো মানবজীবনের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের মূল উপাদানগুলো একে স্বতন্ত্র এবং কার্যকর একটি ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলে। সরকার রাষ্ট্রের পরিচালনাকারী যন্ত্র হিসেবে কাজ করে এবং সার্বভৌমত্বের মাধ্যমে এর ক্ষমতা নিশ্চিত হয়। জনসমষ্টি এবং ভূখণ্ড রাষ্ট্রের শারীরিক ভিত্তি গঠন করে। তাই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এর প্রতিটি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ এবং একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।