ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? 

ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? 

ভূমিকা: নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী, একজন প্রভাবশালী ইতালীয় দার্শনিক এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, যিনি আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রদূত হিসেবে বিবেচিত। তিনি ১৪৬৯ সালে ফ্লোরেন্সে একটি উচ্চবংশীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার পিতা ছিলেন একজন আইনজীবী। বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগে চাকরির মাধ্যমে রাষ্ট্র বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। 

ম্যাকিয়াভেলীর রাষ্ট্রদর্শন ছিল সম্পূর্ণভাবে বাস্তববাদী এবং বস্তুবাদী। তার দুটি প্রধান বই—’দি প্রিন্স’ এবং ‘ডিসকোর্সেস’—এ তিনি তার রাষ্ট্রদর্শন উপস্থাপন করেন। তিনি মধ্যযুগীয় ধর্মীয় চিন্তাভাবনার চক্র থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটান। এ কারণেই তাকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

ম্যাকিয়াভেলীবাদ: ম্যাকিয়াভেলীবাদের আক্ষরিক অর্থ হলো ধূর্ততা, কপটতা, প্রতারণা, এবং দ্বিমুখী নীতি। ম্যাকিয়াভেলী মনে করতেন, শাসকের উচিত সবসময় জনগণের মনে ভীতির সঞ্চার করা, তা নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা বা চাতুর্যের মাধ্যমে হোক। তিনি শাসককে প্রেম, দয়া, এবং সহানুভূতির মতো মানবিক গুণাবলি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার মতে, রাজনীতি হলো একটি স্বাধীন বিষয়, যা ধর্ম ও নীতি-নৈতিকতার বিধিনিষেধের বাইরে থাকা উচিত। 

আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ

তিনি বাস্তবতা এবং অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং কল্পনার কোনো মূল্য দিতেন না। মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর এবং প্রতারণাপ্রবণ, তাই তাদেরকে নৈতিক বা ধর্মীয় আদর্শ দিয়ে শাসন করা সম্ভব নয়।

ম্যাকিয়াভেলীর সময়ে ইতালির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল চরম সংকটপূর্ণ। এই সংকটের প্রতিফলন ঘটেছে তার চিন্তায়। এ কারণে তার রাজনৈতিক চিন্তা এবং দর্শনই ‘ম্যাকিয়াভেলীবাদ’ নামে পরিচিত।

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক হিসেবে ম্যাকিয়াভেলী:

নিম্নে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক হিসেবে ম্যাকিয়াভেলীর অবদান আলোচনা করা হলো:

১. জাতীয় রাষ্ট্রের প্রথম প্রবক্তা: ম্যাকিয়াভেলী প্রথম ব্যক্তি, যিনি জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা দেন। তিনি ইতালির বহুধাবিভক্ত অবস্থা দেখে একটি শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং তার রাষ্ট্রদর্শনের মাধ্যমে সেই রূপরেখা প্রদান করেন। তার এই চিন্তাধারা সমগ্র ইউরোপে প্রভাব ফেলেছিল এবং তা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

২. অভিজ্ঞতাবাদী চিন্তক: ম্যাকিয়াভেলী তার চিন্তাধারায় অভিজ্ঞতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার মতে, প্রতিটি বিষয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। তিনি ইতালির তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতেন, যা তাকে একজন অভিজ্ঞতাবাদী চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা

৩. উপযোগবাদী চিন্তা: ম্যাকিয়াভেলীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উপযোগবাদী। তার মতে, অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিটি বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা এবং উপযোগিতা নির্ধারণ করতে হবে। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, যা কাজ করে, তা-ই গ্রহণযোগ্য, এবং শাসনের ক্ষেত্রে এই উপযোগবাদী চিন্তা প্রয়োগ করতে হবে।

৪. সর্বাত্মকবাদী চিন্তক: ম্যাকিয়াভেলী মনে করতেন, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য শাসকের হাতে চরম ক্ষমতা থাকা উচিত। তার মতে, শাসকের প্রধান লক্ষ্য হবে ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপর রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। এই ধারণাই সর্বাত্মকবাদের জন্ম দেয়, যেখানে রাষ্ট্রের স্বার্থ সবার উপরে থাকে।

৫. রাজনীতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি স্থাপন: ম্যাকিয়াভেলী প্রথম ব্যক্তি, যিনি রাজনীতিকে একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। এরিস্টটলের মতো তিনিও বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনি রাষ্ট্রচিন্তার জন্য যুক্তিবাদী এবং বাস্তবতাবাদী পদ্ধতি গ্রহণ করেন।

আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব

৬. আইনের শাসন: ম্যাকিয়াভেলী আইনের শাসনের পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী আইন প্রণেতার প্রয়োজন। তার মতে, আইনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করাই একটি রাষ্ট্রের সফলতা নিশ্চিত করবে।

কেন ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়:

ম্যাকিয়াভেলীর চিন্তাধারায় এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যা তাকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল, যা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:

১. রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথকীকরণ: ম্যাকিয়াভেলী ছিলেন প্রথম চিন্তাবিদ, যিনি রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করার কথা বলেন। তার মতে, রাষ্ট্রের ওপর কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাব থাকা উচিত নয়। তিনি ধর্মীয় চিন্তাধারা থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। এজন্য তাকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রদূত বলা হয়।

২. নৈতিকতার ঊর্ধ্বে রাজনীতি: ম্যাকিয়াভেলী তার রাজনীতির দর্শনকে নৈতিকতা এবং ধর্মীয় বিধিবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, রাজনীতিতে লক্ষ্যই সবকিছু নির্ধারণ করে এবং প্রয়োজন হলে আইনের শাসন অমান্য করা যেতে পারে। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তির জীবনে যা অন্যায়, তা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে।

আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? 

৩. জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস: ম্যাকিয়াভেলী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয় ঐক্য এবং অভিন্ন আইনব্যবস্থা একটি শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি। তার চিন্তাধারা জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৪. আধুনিক কূটনীতির জনক: ম্যাকিয়াভেলী আধুনিক কূটনীতির জনক হিসেবে পরিচিত। তিনি শাসকদের জন্য যে রাজনৈতিক পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা আধুনিক কূটনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছে। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে।

৫. আইনের প্রণেতা: ম্যাকিয়াভেলী আইনের প্রতি আনুগত্য এবং আইনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি মনে করতেন, শক্তিশালী আইন ব্যবস্থা এবং তার যথাযথ প্রয়োগ একটি রাষ্ট্রের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। এজন্য তিনি আধুনিক নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা করেন।

৬. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা: ম্যাকিয়াভেলীর অন্যতম বড় অবদান ছিল রাষ্ট্র নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা। মধ্যযুগে রাষ্ট্রকে ঐশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হতো, যেখানে শাসক ছিল ঈশ্বরের প্রতিনিধি। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলী রাষ্ট্রকে মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বাস্তবিক পদ্ধতি প্রস্তাব করেন।

৭. প্রজাতন্ত্রের গুরুত্ব: ম্যাকিয়াভেলী রাজতন্ত্রের সমর্থক হলেও প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থারও গুণগান করেছেন। তিনি মনে করতেন, সুসংগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজতন্ত্র প্রয়োজন, কিন্তু জনগণের স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণকারী সরকারও গুরুত্বপূর্ণ। তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করে।

৮. শাসনকার্যে জনগণের ভূমিকা: ম্যাকিয়াভেলী বিশ্বাস করতেন, একটি সফল শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে শাসনব্যবস্থা অধিক স্থায়ী হয় এবং দেশ অধিক কল্যাণকর হয়।

৯. সার্বভৌমত্বের ধারণা: ম্যাকিয়াভেলী প্রথম আধুনিক সার্বভৌমত্বের ধারণা দেন। তিনি শাসকের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন, যা সার্বভৌমত্বের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

১০. নৈতিকতার আধুনিক ব্যাখ্যা: ম্যাকিয়াভেলী তার রাজনৈতিক দর্শনে নৈতিকতার আধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, ব্যক্তিগত নৈতিকতা এবং সরকারি নৈতিকতা পৃথক হতে পারে। এই ধারণা তাকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

উপসংহার: ম্যাকিয়াভেলীবাদ মধ্যযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ, যা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি স্থাপন করেছে। ম্যাকিয়াভেলী ধর্ম এবং নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে পৃথক করেছেন এবং রাজনীতিকে একটি স্বাধীন ও বাস্তববাদী বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার এই মতবাদ পরবর্তীকালে অনেক রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের প্রভাবিত করেছে এবং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনে অবদান রেখেছে। সুতরাং, ম্যাকিয়াভেলীকে যথার্থই আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক বলা যায়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263