সার্বভৌমত্ব ও সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণা

সার্বভৌমত্ব ও সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণা

ভূমিকা: সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা রাষ্ট্রকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সত্তা হিসেবে গড়ে তোলে। এটি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত, চরম ও অবাধ ক্ষমতা নির্দেশ করে। সার্বভৌমত্ব ছাড়া রাষ্ট্রের পূর্ণতা কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগ্রহণ ও কার্য পরিচালনার ক্ষমতা হিসেবে কাজ করে।

সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সার্বভৌমত্বকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন:

মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক বার্জেস বলেছেন, “সার্বভৌমত্ব হলো সকল প্রজা ও সংগঠনের ওপর চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ ও সীমাহীন ক্ষমতা।”

ব্লাকষ্টোন বলেছেন, “সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের চরম, অপ্রতিরোধ্য, শর্তহীন কর্তৃত্ব।”

উইলোবি বলেন, “সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা।”

আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা

সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণা: বহুত্ববাদী ধারণা অনুযায়ী, সার্বভৌমত্ব চূড়ান্ত বা অবিভাজ্য নয়। রাষ্ট্র একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয় এবং রাষ্ট্রের পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানও স্বাধীনভাবে কাজ করে। এই ধারণাটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেয়।

বহুত্ববাদী ধারণার মূল যুক্তিসমূহ:

১. রাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের অস্তিত্ব: বহুত্ববাদীরা মনে করেন যে, রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজে অন্যান্য সামাজিক সংগঠন যেমন—ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তারা মানুষের স্বাধীনতায় সহায়ক এবং তাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন হতে পারে না।

২. মানুষের স্বাধীনতা: বহুত্ববাদীদের মতে, সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত ধারণা ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী। যদি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকে, তবে মানুষের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হবে। সুতরাং, সমাজের অন্যান্য সংস্থাগুলিরও নির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকা উচিত।

৩. গিয়ার্কে ও মেইটল্যান্ডের মতবাদ: গিয়ার্কে ও মেইটল্যান্ড বলেন, সমাজের বিভিন্ন স্থায়ী সংগঠন স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠে এবং রাষ্ট্র এগুলিকে সৃষ্টি করেনি। রাষ্ট্রকে তাদের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। এদেরও কিছু নির্দিষ্ট স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন।

৪. রাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: বহুত্ববাদীরা মনে করেন, সার্বভৌমত্ব অবাধ, অসীম ও চূড়ান্ত হতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতার সীমা থাকে এবং সংবিধান বা আইন দ্বারা এই সীমা নির্ধারিত হয়।

আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? 

বহুত্ববাদী ধারণার বৈশিষ্ট্যসমূহ:

১. চূড়ান্ত নয়: বহুত্ববাদীদের মতে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা চূড়ান্ত বা সর্বোচ্চ নয়। আন্তর্জাতিক আইন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

২. অবিভাজ্য নয়: সার্বভৌমত্বকে বহুত্ববাদীরা অবিভাজ্য বলে মনে করেন না। তারা বলেন, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম।

৩. অহস্তান্তরযোগ্য নয়: বহুত্ববাদীরা মনে করেন, সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা সরকারের হাতে অর্পণ করা হয়, যা নির্দিষ্ট সময় পরে পরিবর্তিত হয়।

বহুত্ববাদী ধারণার সমালোচনা:

১. চরম ক্ষমতার প্রয়োজন: বহুত্ববাদীরা যে যুক্তি দেন যে সার্বভৌম ক্ষমতা চূড়ান্ত নয়, তা সমালোচিত হয়েছে। সার্বভৌম ক্ষমতা যদি চূড়ান্ত না হয়, তবে রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে।

২. অবাধ ক্ষমতা: সার্বভৌমত্বের অবাধ ক্ষমতা না থাকলে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন করতে পারবে না, যা সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাজের অন্তর্গত।

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা

৩. অবিভাজ্য ক্ষমতা: রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অবিভাজ্য। রাষ্ট্রের ভেতরের কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের সমান সার্বভৌমত্ব পেতে পারে না।

উপসংহার: সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের ক্ষমতার চূড়ান্ত ধারণা হলেও বহুত্ববাদী মতবাদ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার চূড়ান্ততাকে সীমিত করে। বাস্তবিকভাবে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন, যা সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনগণের ওপর নির্ভরশীল।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252