সংবিধান কি? উত্তম সংবিধানের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

সংবিধান কি? উত্তম সংবিধানের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

ভূমিকা: সংবিধান হলো একটি রাষ্ট্রের মৌলিক আইন ও পবিত্র দলিল। এটি রাষ্ট্রের আইন ও প্রশাসন পরিচালনার মূল ভিত্তি। সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো, সরকার এবং নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, যার অধীনে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালিত হয়। একজন নাগরিক কী ধরনের অধিকার ভোগ করবে, কীভাবে তাদের কর্তব্য পালন করবে, এবং রাষ্ট্র কীভাবে কাজ করবে—এসব বিষয় সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। তাই সংবিধানকে রাষ্ট্রের আয়না বা দর্পণ বলা হয়।

সংবিধানের প্রামাণ্য সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞায় সংবিধানের গুরুত্ব ও প্রভাব ফুটে ওঠে। নিচে সংবিধানের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:

  • গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, “কোন রাষ্ট্র নিজেকে পরিচালনার জন্য যে পথ বেছে নেয় তাই সংবিধান।”
  • অধ্যাপক ফাইনার বলেছেন, “রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে পরস্পরের সম্পর্কই হলো সংবিধান।”
  • সি.এফ. ষ্ট্রং সংবিধানের আরও এক সুন্দর সংজ্ঞা দেন, “সংবিধান হচ্ছে সেই সকল নিয়মের সমষ্টি যা সরকারের ক্ষমতা, শাসিতের অধিকার এবং এ দু’য়ের সম্পর্ক নির্ধারণ করে।”

উত্তম সংবিধানের সংজ্ঞা:

একটি উত্তম সংবিধান হচ্ছে সেই সংবিধান যা নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা করে এবং নাগরিকদের অধিকার সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করে। উত্তম সংবিধান একটি রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো প্রদান করে, যেখানে জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এটি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার পথনির্দেশ করে।

আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? 

বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী K.C. Wheare বলেছেন, “উত্তম সংবিধানের জন্য গণতন্ত্রই হলো উত্তম ক্ষেত্র।” অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উত্তম সংবিধান বাস্তবায়ন করা সহজতর হয়, কারণ এখানে জনগণের ইচ্ছা ও মতামতের প্রতিফলন ঘটে।

উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ:

১. সুস্পষ্টতা: উত্তম সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ধারাসমূহের সুস্পষ্টতা। সংবিধানের প্রতিটি ধারায় সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে যাতে তা ব্যাখ্যার সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়। অস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থপূর্ণ ভাষার ব্যবহারের ফলে আইনের অপব্যাখ্যা হতে পারে, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।

২. সংক্ষিপ্ততা: সংবিধানের বিভিন্ন ধারা ও উপধারা সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে অপ্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রসঙ্গের অনুপ্রবেশ এড়িয়ে মূল বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। তবে এটি সংক্ষিপ্ত হলেও রাষ্ট্রের কাঠামো, শাসনব্যবস্থা এবং জনগণের মৌলিক অধিকারের বিস্তারিত উল্লেখ থাকা উচিত।

৩. মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্তি: উত্তম সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত থাকে। সংবিধান নাগরিকদের মত প্রকাশ, ধর্মাচারণ, এবং জীবিকার অধিকারসহ বিভিন্ন মৌলিক অধিকার প্রদান করে। এই অধিকারগুলো সরকার কখনোই লঙ্ঘন করতে পারে না এবং নাগরিকরা এসব অধিকারের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে শাসনতন্ত্রভঙ্গের অভিযোগ আনতে পারে।

৪. সময়োপযোগিতা: উত্তম সংবিধান অবশ্যই সময়োপযোগী হতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধানকে সংশোধন ও পরিবর্তন করতে হবে। একটি অপরিবর্তনীয় সংবিধান নাগরিকদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না, ফলে এটি সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব

৫. সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা: উত্তম সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার সঠিক ভারসাম্য রক্ষা। সংবিধান এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে জনগণ ও সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে। জনগণ যদি শাসকের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়, তবে তা বিপ্লব এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।

৬. গণতন্ত্র: উত্তম সংবিধানের আরেকটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংবিধান জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়। সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটে। K.C. Wheare বলেন, “উত্তম সংবিধানের জন্য গণতন্ত্রই হলো উত্তম ক্ষেত্র।”

৭. সহজ সংশোধন পদ্ধতি: উত্তম সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি সহজ এবং সুনির্দিষ্ট হতে হবে। তবে সংশোধন পদ্ধতি এত সহজ হওয়া উচিত নয় যে তা অহেতুক এবং অপ্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি করে। সংশোধন প্রক্রিয়া জটিল হলেও তা সময়োপযোগী হওয়া উচিত যাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনায় সহজ হয়।

৮. লিখিত রূপ: উত্তম সংবিধান সাধারণত লিখিত হওয়া কাম্য। লিখিত সংবিধানের সুবিধা হলো এটি স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও বিধান দেয়। এটি নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। অধিকাংশ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই লিখিত সংবিধান বিদ্যমান।

৯. জনমতের অগ্রাধিকার: উত্তম সংবিধান সবসময় জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সংবিধান জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে এবং সময়ে সময়ে জনমতের ভিত্তিতে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে পারে।

১০. বিচার বিভাগের প্রাধান্য: উত্তম সংবিধানকে কার্যকর রাখার জন্য বিচার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগ সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান ও সংরক্ষণ করে। বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা দিলে সংবিধানের সঠিক প্রয়োগ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। বিচার বিভাগ হলো সংবিধানের অভিভাবক ও রক্ষক।

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা

উপসংহার: উত্তম সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। এটি রাষ্ট্র পরিচালনার সঠিক নিয়মকানুন প্রদান করে, যা নাগরিকদের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি উত্তম সংবিধান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252