সমাজবিজ্ঞানে অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান

Avatar

Al Amin

Academic

সমাজবিজ্ঞানে অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান


ভূমিকা: একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশে অগাস্ট কোঁতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনিই প্রথম সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে তাকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। কোঁৎ সামাজিক চিন্তা ও তত্ত্বকে একত্র করে সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি রচনা করেন। এ কারণেই তাকে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।


জন্ম ও শিক্ষা: অগাস্ট কোঁৎ ১৭৯৮ সালে ফ্রান্সের মন্টপেলিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৫৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রখর স্মরণশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার জন্য তিনি তরুণ বয়সেই ইকলে পলিটেকনিক স্কুলে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৬ বছর বয়সে সেন্ট সিমনের সাহচর্যে পড়ালেখা করেন এবং সমাজ দর্শনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে দার্শনিকদের তত্ত্ব এবং চিন্তা তাকে সমাজ সম্পর্কিত গভীর চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে।


আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব


সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অগাস্ট কোঁতের ভূমিকা: অগাস্ট কোঁৎকে সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করার তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে:

  • Sociology শব্দের প্রবর্তন: কোঁৎই সর্বপ্রথম Sociology (সমাজবিজ্ঞান) শব্দটি ব্যবহার করেন এবং এই শব্দের মাধ্যমে তিনি একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের পরিচয় প্রদান করেন।
  • প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান: কোঁৎ সমাজচিন্তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন, যা সমাজবিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেয়।
  • সমাজতাত্ত্বিক চিন্তার ধারা: তার চিন্তাধারা অনুসরণের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান আজকের বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত শাখা হিসেবে বিকশিত হয়েছে।


সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে কোঁতের অবদান:


১. সমাজবিজ্ঞানের নামকরণ: অগাস্ট কোঁৎ রেনেসাঁ এবং ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সমাজের প্রেক্ষাপটে Social Physics নামে একটি বিজ্ঞান প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে ১৮৩৯ সালে তিনি এই বিজ্ঞানের নাম দেন Sociology বা সমাজবিজ্ঞান। এই নামকরণের মাধ্যমে তিনি সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং সমাজ নিয়ে অধ্যয়নকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।


আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ


২. গবেষণা পদ্ধতি: অগাস্ট কোঁতের মতে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সমাজ গবেষণায়ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা উচিত। তার অনুসৃত গবেষণা পদ্ধতিগুলো ছিল:

  • পর্যবেক্ষণ: সমাজের বিভিন্ন ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে সামাজিক পরিবর্তন ও কার্যক্রম বিশ্লেষণ করা।
  • পরীক্ষামূলক পদ্ধতি: বিভিন্ন পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজের কার্যকলাপ বোঝার প্রয়াস।
  • তুলনামূলক বিশ্লেষণ: বিভিন্ন সমাজ এবং সংস্কৃতির মধ্যে তুলনা করে সমাজের গঠন এবং পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা।


৩. রচনাবলি: অগাস্ট কোঁতের গুরুত্বপূর্ণ রচনা হলো Positive Philosophy, যা ১৮৩০ থেকে ১৮৪২ সালের মধ্যে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তার আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ Positive Polity চার খণ্ডে ১৮৫১ থেকে ১৮৫৪ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়। এই রচনাগুলোতে তিনি সমাজবিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্ব এবং চিন্তা উপস্থাপন করেন।


৪. দৃষ্টবাদ: কোঁৎ তার দৃষ্টবাদী (Positive) তত্ত্বের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা এবং স্থিতিশীলতা সম্পর্কে আলোচনা করেন। দৃষ্টবাদ তার দার্শনিক চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি বলেন, মানবসমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য দৃষ্টবাদ প্রয়োজনীয়। দৃষ্টবাদকে তিনি তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন:

  • বিজ্ঞানসমূহের দর্শন
  • বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র
  • দৃষ্টবাদী রাজনীতি


৫. মানব প্রগতির ত্রিস্তরের সূত্র: অগাস্ট কোঁতের মানব প্রগতির ত্রিস্তরের সূত্র হলো মানুষের মানসিক, সামাজিক এবং জ্ঞানের উন্নতির ধারা। তিনি মানব প্রগতিকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন:

  • ধর্মতাত্ত্বিক স্তর: এখানে মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামরিক কর্তৃত্বের ওপর নির্ভরশীল থাকে। পরিবার এই স্তরের প্রধান সামাজিক ঐক্য।
  • অধিবিদ্যা সম্বন্ধীয় স্তর: ধর্ম থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তায় উত্তরণের মধ্যবর্তী স্তর এটি।
  • দৃষ্টবাদী স্তর: এই স্তরে মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার ওপর নির্ভরশীল হয়। এটি শিল্পবিপ্লবের যুগ হিসেবে পরিচিত।


৬. সামাজিক উন্নতির ক্রমিক ধাপ: কোঁৎ সামাজিক বিবর্তনকে তিনটি ধাপে ভাগ করেছেন:

  • বুদ্ধিগত উন্নতি: মানুষের চিন্তা এবং ধ্যানধারণার উন্নতি।
  • ভাবগত উন্নতি: অনুভূতি এবং সামাজিক সম্পর্কের উন্নতি।
  • কর্মগত উন্নতি: মানুষের কাজ এবং সামাজিক ক্রিয়াকলাপের উন্নতি।


৭. বিজ্ঞানসমূহের উচ্চক্রম: অগাস্ট কোঁৎ বিভিন্ন বিজ্ঞানের জটিলতা এবং কার্যক্ষেত্রের পরিধি অনুযায়ী বিজ্ঞানের উচ্চক্রম নির্ধারণ করেছেন। তার ক্রম অনুযায়ী সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে অঙ্কশাস্ত্র এবং সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে সমাজবিজ্ঞান। তিনি মনে করেন, সমাজবিজ্ঞান হলো একটি সমন্বিত বিজ্ঞান যা অন্যান্য বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করে।


আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা


৮. স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেরণা: কোঁৎ সামাজিক উন্নয়নের জন্য সমাজকে স্বাবলম্বী হওয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, দ্বৈবশক্তির প্রভাবে সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। এ ধরনের ধারণা রাজতন্ত্র এবং সামরিক প্রভাব তৈরি করে, যা সমাজের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই তিনি মানুষকে স্বাবলম্বী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার মাধ্যমে সমাজ গঠনের পরামর্শ দেন।


উপসংহার: অগাস্ট কোঁতের চিন্তা, তত্ত্ব এবং গবেষণার মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম এবং বিকাশ সম্ভব হয়েছে। তিনি সমাজ গবেষণার পদ্ধতি এবং তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও তার সব পদ্ধতি এবং ধারণা বর্তমান সমাজবিজ্ঞানীরা অনুসরণ করেন না, তবুও সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে তার অবদান চিরস্মরণীয়। তার প্রচেষ্টা সমাজবিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা গঠনে সহায়ক হয়েছে, যা আজকের দিনে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

Get Our App

Download our app for a better experience.

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD