সমাজকল্যাণ ও সমাজ সংস্কারে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদান
ভূমিকা: শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন ব্রিটিশ শাসিত বাংলার একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ। তিনি সাধারণ জনগণের বিশেষ করে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, বরং সমাজকল্যাণ, শিক্ষা বিস্তার এবং শ্রমিকদের কল্যাণ সাধনে তার অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শেরে বাংলা নামে খ্যাত ফজলুল হক তার সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং রাজনীতি দ্বারা বাংলার মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন।
সমাজকল্যাণ ও সমাজ সংস্কারে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদান:
১. সমাজ সংস্কারের প্রতি দায়বদ্ধতা: ফজলুল হক সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তিনি সমাজের শোষিত ও অবহেলিত মানুষদের পক্ষে লড়াই করে তাদের মুক্তির পথ তৈরি করেছেন। সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম তাকে একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আরো পড়ুনঃ সমাজ সংস্কার কাকে বলে?
২. প্রতিবাদী কণ্ঠ: ফজলুল হক বাংলার জমিদার ও মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সাধারণ কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বাংলার কৃষক-শ্রমিকদের জন্য স্বকীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেন এবং বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
৩. সমাজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা: তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজের উন্নতি করতে হলে প্রথমে দরিদ্র, অসহায় এবং শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাই তিনি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন প্রকল্পে অংশ নেন এবং দরিদ্র মানুষের জন্য শিক্ষার বিস্তার, আর্থিক সাহায্য এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদান:
১. নারীশিক্ষার প্রসার: ফজলুল হক নারীদের শিক্ষার প্রসারের জন্য বিশেষভাবে কাজ করেন। তিনি ১৯৩৭ সালে নারী শিক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে “লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ” প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২. শিক্ষা পরিকল্পনা বিল: ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদে “শিক্ষা পরিকল্পনা বিল” উত্থাপন করেন, যা এদেশে শিক্ষা বিস্তারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে বাংলায় শিক্ষার বিস্তার ঘটান।
৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা: ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় পরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।
আরো পড়ুনঃ বিভারিজ রিপোর্টের পঞ্চদৈত্য ও সুপারিশসমূহ
শ্রমিকদের কল্যাণে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদান:
১. কৃষক-প্রজার অধিকার প্রতিষ্ঠা: ফজলুল হক বাংলার কৃষক শ্রেণিকে জমিদার ও মহাজনদের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য কাজ করেন। ১৯১৩ সালে তিনি “কৃষক ঋণ আইন” পাস করেন, যার মাধ্যমে কৃষকরা ঋণের দায় থেকে মুক্তি পান এবং তাদের সম্পত্তি রক্ষার সুযোগ পান।
২. প্রজাস্বত্ব আইন পাস: ১৯২৮ সালে প্রজাস্বত্ব আইন পাসের মাধ্যমে ফজলুল হক কৃষকদের জমির অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই আইন জমিদারদের হাতে কৃষকদের শোষণ বন্ধ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। ১৯৩৭ সালে এই আইনের সংশোধন করে প্রজাদের জমির অধিকার আরো সুসংহত করা হয়।
৩. কৃষক প্রজা আন্দোলন: শেরে বাংলা কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য ১৯২৭ সালে “কৃষক প্রজা পার্টি” গঠন করেন। এই পার্টি বাংলার কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়াই করে এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করে। কৃষকদের সংগঠিত করার মাধ্যমে ফজলুল হক বাংলায় কৃষক আন্দোলনের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন।
৪. ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন: মহাজনদের শোষণ থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য ফজলুল হক ১৯৩৭ সালে “ঋণ সালিসি বোর্ড” গঠন করেন। এই বোর্ডের মাধ্যমে কৃষকদের ঋণ পরিশোধের সুবিধা প্রদান করা হয় এবং মহাজনদের অবৈধ সুদের বোঝা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
৫. জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ: শেরে বাংলার প্রচেষ্টায় ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস হয়। জমিদারি প্রথা বাংলার কৃষকদের উপর দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা শোষণের প্রতীক ছিল, এবং এই প্রথা উচ্ছেদের মাধ্যমে কৃষকরা জমির মালিকানা লাভ করে।
আরো পড়ুনঃ সামাজিক সমস্যা কাকে বলে?
উপসংহার: শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদান বাংলার কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য এক অপার মানবিক সেবা হিসেবে স্মরণীয়। তিনি দরিদ্র মানুষের জন্য তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, কৃষি সংস্কার এবং শিক্ষা বিস্তারে যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তা বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর কর্মময় জীবন এবং শ্রমিক ও কৃষকদের জন্য কাজ করে যাওয়া অবদান আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণাদায়ক।