বিভারিজ রিপোর্টের পঞ্চদৈত্য ও সুপারিশসমূহ

বিভারিজ রিপোর্টের পঞ্চদৈত্য ও সুপারিশসমূহ

ভূমিকা: বিভারিজ রিপোর্ট (Beveridge Report) ১৯৪২ সালে স্যার উইলিয়াম বিভারিজের নেতৃত্বে প্রকাশিত হয়, যা ইংল্যান্ডের সমাজকল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে এক বিপ্লবী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং সমাজে সমতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য এই রিপোর্টের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বিভারিজ রিপোর্টে ইংল্যান্ডের সামাজিক অগ্রগতির পথে পাঁচটি প্রধান অন্তরায়কে “পঞ্চদৈত্য” নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

বিভারিজ রিপোর্ট: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমাজের আর্থসামাজিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে ১৯৪১ সালে স্যার উইলিয়াম বিভারিজের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৪২ সালে এই কমিটি “বিভারিজ রিপোর্ট” প্রকাশ করে, যা ইংল্যান্ডের কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে।

পঞ্চদৈত্য: 

বিভারিজ রিপোর্টে উল্লেখিত পাঁচটি অন্তরায়কে পঞ্চদৈত্য (Five Giants) বলা হয়, যা মানবসমাজের অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এই পাঁচটি দৈত্য হলো:

১. অভাব (Want): দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সংকট, যা মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতা সৃষ্টি করে।

২. রোগব্যাধি (Disease): সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়া রোগ ও অসুস্থতা, যা স্বাস্থ্যসেবার অভাব ও অব্যবস্থাপনার ফল।

৩. অজ্ঞতা (Ignorance): শিক্ষার অভাব, যা মানুষের জ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

আরো পড়ুনঃ শিল্প বিপ্লব কাকে বলে?

৪. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ (Squalor): দারিদ্র্য ও অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের ফলে সৃষ্ট অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যা মানুষের জীবনযাত্রার মান হ্রাস করে।

৫. অলসতা (Idleness): কর্মসংস্থানের অভাব এবং এর ফলে সৃষ্ট অলসতা ও বেকারত্ব, যা সমাজে আর্থিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে।

বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশমালা:

বিভারিজ রিপোর্টে পাঁচটি দৈত্য মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির সুপারিশ করা হয়েছিল। মূলত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষের জীবনমান উন্নত করার প্রস্তাব ছিল। বিভারিজ রিপোর্টের প্রধান সুপারিশগুলো হলো:

১. একীভূত ও সর্বাত্মক সামাজিক বীমা কর্মসূচি: একটি সার্বিক এবং একীভূত সামাজিক বীমা কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

২. জাতীয় সাহায্য কর্মসূচি: সামাজিক বীমা সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের জন্য একটি জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করা।

৩. শিশু ভাতা প্রদান: প্রথম শিশুর পর প্রতিটি শিশুর জন্য সাপ্তাহিক ভিত্তিতে শিশু ভাতা প্রদান, যা বর্তমানে পারিবারিক ভাতা নামে পরিচিত।

আরো পড়ুনঃ সমাজ সংস্কার কাকে বলে?

৪. বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন সেবা: সকল স্তরের জনগণের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করা।

৫. পূর্ণ কর্মসংস্থান: অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় গণবেকারত্ব প্রতিরোধ করতে পূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য সরকারিভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

সুপারিশকৃত নীতিমালা:

বিভারিজ রিপোর্টে সুপারিশকৃত নীতিমালাগুলো বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি মৌলিক নীতি উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো:

1. একীভূত প্রশাসন: সকল সেবামূলক কার্যক্রমকে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত করা।

2. বিস্তৃত কর্মসূচি: জনগণের সকল চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিস্তৃত কর্মসূচির অন্তর্ভুক্তিকরণ।

3. সমান হারে চাঁদা প্রদান: প্রত্যেক নাগরিক সমানভাবে এই কর্মসূচিতে আর্থিক অবদান রাখবে।

4. সমান সুবিধা প্রদান: সেবা গ্রহণকারীদের জন্য সমানভাবে সুযোগ ও সুবিধা নিশ্চিত করা।

5. প্রয়োজনীয় সার্বিক সাহায্য: প্রত্যেক গ্রহীতা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের মতো পর্যাপ্ত সাহায্য পাবেন।

6. জনসংখ্যার শ্রেণীবিভাজন: সমাজের সকল শ্রেণির জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করে ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

আরো পড়ুনঃ দান সংগঠন সমিতি কি?

উপসংহার: বিভারিজ রিপোর্ট ছিল ইংল্যান্ডের কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিপ্রস্তর। এর পঞ্চদৈত্য সমাজের উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, এবং এসব অন্তরায় দূর করতে বিভারিজ যে সুপারিশমালা দিয়েছিলেন, তা ইংল্যান্ডের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263