অপরাধ সম্পর্কে সাদারল্যান্ডের তত্বটি আলোচনা করো
ভূমিকা: আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে. সাদারল্যান্ড তার বিখ্যাত “দ্য সাইকোলজি অব সানডিগ্রেড ক্রাইম” (১৯৫৭) গ্রন্থে বিচ্যুতি ও অপরাধ সংক্রান্ত একটি তত্ত্ব প্রদান করেন, যা “বিভিন্নমুখী মেলামেশা তত্ত্ব” নামে পরিচিত। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, বিচ্যুতি ও অপরাধ একটি সামাজিক নির্মাণ, যা সামাজিক প্রত্যাশা, নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সাদারল্যান্ডের মতে, বিচ্যুতি ও অপরাধকে একটি নিরপেক্ষ ধারণা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। বরং, এটিকে একটি সামাজিক নির্মাণ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। অর্থাৎ, বিচ্যুতি ও অপরাধ হল এমন আচরণ যা একটি নির্দিষ্ট সমাজে বিচ্যুত বা অপরাধমূলক বলে বিবেচিত হয়।
সাদারল্যান্ডের তত্ত্বের মূল উপাদান হল “বিভিন্নমুখী মেলামেশা”। এই শব্দটি দ্বারা বোঝায় যে, সমাজে বিচ্যুতি ও অপরাধের ক্ষেত্রে একটি ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। অর্থাৎ, একটি আচরণকে বিচ্যুত বা অপরাধমূলক বলে বিবেচিত হওয়ার জন্য, সেটিকে অবশ্যই সমাজের সবচেয়ে বিচ্যুত বা অপরাধমূলক আচরণের সাথে তুলনা করা উচিত।
অপরাধ সংক্রান্ত সাদারল্যান্ডের বিভিন্নমুখী মেলামেশা তত্ত্ব
অপরাধ সংক্রান্ত সাদারল্যান্ডের বিভিন্নমুখী মেলামেশা তত্ত্বটি ১৯৭৫ সালে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধবিদ এডওয়ার্ড সাদারল্যান্ড প্রবর্তন করেন। এই তত্ত্বে তিনি অপরাধকে একটি সামাজিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেন এবং অপরাধের কারণ হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণগুলির উপর জোর দেন।
আরো পড়ুনঃ মানব ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
সাদারল্যান্ডের মতে, অপরাধ একটি জটিল সামাজিক ঘটনা যা বিভিন্নমুখী কারণগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই কারণগুলিকে তিনি চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেন:
অর্থনৈতিক কারণ: সাদারল্যান্ডের মতে, অর্থনৈতিক অসমতা ও দারিদ্র্য অপরাধের প্রধান কারণ। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তিরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য।
সামাজিক কারণ: সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক অস্থিরতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অভাব অপরাধের কারণ হতে পারে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সামাজিক সংযোগ ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে।
রাজনৈতিক কারণ: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক দুর্নীতি অপরাধের কারণ হতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যক্তিরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
সাংস্কৃতিক কারণ: সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি ও সাংস্কৃতিক সহিংসতা অপরাধের কারণ হতে পারে। সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্যুত ব্যক্তিরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অভাবে।
সাদারল্যান্ডের বিভিন্নমুখী মেলামেশা তত্ত্বের প্রধান বিষয়গুলি নিম্নরূপ:
১. অপরাধ একটি সামাজিক ঘটনা: সাদারল্যান্ডের মতে, অপরাধ একটি সামাজিক ঘটনা যা শুধুমাত্র ব্যক্তির ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বা মনোবিজ্ঞানের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। অপরাধের কারণ হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণগুলির উপর জোর দেয়া হয়।
২. অপরাধের বিভিন্নমুখী কারণ: সাদারল্যান্ডের মতে, অপরাধের একটি নির্দিষ্ট কারণ নেই। অপরাধের কারণ হিসেবে বিভিন্নমুখী কারণগুলির একটি জটিল মিথস্ক্রিয়া কাজ করে।
৩. অপরাধের সামাজিক প্রভাব: সাদারল্যান্ডের মতে, অপরাধ শুধুমাত্র অপরাধী ব্যক্তির উপর প্রভাব ফেলে না। অপরাধ সামাজিক স্তরেও প্রভাব ফেলে। অপরাধের ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি পায়।
আরো পড়ুনঃ মাদকাসক্তি কি? এ সমস্যার সমাধানে একজন সমাজকর্মীর ভূমিকা
৪. অপরাধের প্রতিরোধ: সাদারল্যান্ডের মতে, অপরাধের প্রতিরোধের জন্য শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া যথেষ্ট নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
৫. অপরাধের নিয়ন্ত্রণ: সাদারল্যান্ডের মতে, অপরাধের নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অপরাধের কারণগুলি দূর করা প্রয়োজন।
৬. অপরাধের প্রতিক্রিয়া: সাদারল্যান্ডের মতে, অপরাধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে অপরাধীদের শাস্তির পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সাদারল্যান্ড এর বিভিন্নমুখী মেলামেশা মতবাদের সমালোচনা
যদিও সাদারল্যান্ড এর বিভিন্নমুখী মেলামেশার তত্ত্বটি সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব পেয়েছে, তথাপি তাঁর তত্ত্বটি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ণ: সাদারল্যান্ড এর তত্ত্বের বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। তাঁর প্রস্তাবনাগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয় নি। তাই Differential association সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায় না।
২. অপরাধীর সাথে মেলামেশা করার প্রভাব: অপরাধীর সাথে মেলামেশা করলেই মানুষ অপরাধী হচ্ছে এমন ধারণা ঠিক নয়। অপরাধীর সাথে মেলামেশা করেও মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। আবার অপরাধী নয় এমন অনেকের সংস্পর্শে এসেও মানুষ অপরাধ করে। তদুপরি তিনি অপরাধীদের সাথে মেশার মাধ্যমে অপরাধী হওয়ার শিক্ষা।পেয়ে অপরাধ থেকে যে দূরে থাকা যায়, তার উল্লেখ করেন নি।
৩. মানুষের মুক্ত ইচ্ছার উপেক্ষা: এ তত্ত্বে মানুষের মুক্ত ইচ্ছার গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। মানুষ নিজস্ব চিন্তাশক্তির দ্বারাও অপরাধী হতে উৎসাহিত হতে পারে সে কথা সাদারল্যান্ড উল্লেখ করেন নি। মেলামেশার সময়ে মানুষ নিজের বুদ্ধিবৃত্তির মনোভাব দ্বারাই চালিত হবে, একথা উপেক্ষা করা হয়েছে ।
৪. অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে উপেক্ষা: সাদারল্যান্ড তার তত্ত্বে অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে উপেক্ষা করেছেন। অর্থের সংকট কিংবা মানসিক হতাশাগ্রস্ত হয়েও যে ব্যক্তি অপরাধ করতে পারে তা না বলে তিনি শুধু মেলামেশাকে অপরাধের প্রধান এবং একমাত্র কারণ বলে দায়ী করেছেন।
৫. তত্ত্বের কাঠামোগত দুর্বলতা: এ মতবাদে অপরাধী এবং অপরাধ বিরোধী দুধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসার কথা বলা হয়েছে। এতে করে অপরাধ প্রবণতার পাশাপাশি অপরাধ দমনের শিক্ষাও পাওয়া যায়। এটি তাই অপরাধ তত্ত্ব না হয়ে মানব আচরণ শিক্ষার তত্ত্বে পরিণত হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ পেশা কাকে বলে?
৬. কার্যকরী ক্ষমতা কম: তত্ত্বটি অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়। অনেক অপরাধ, যেমন- অর্থ আত্মসাৎ, ভদ্রবেশী অপরাধ, ইত্যা, আবেগগত অপরাধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব তেমন কার্যকরী নয়।
উপসংহার: সাদারল্যান্ডের বিভিন্নমুখী মেলামেশা তত্ত্ব অপরাধের কারণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে একটি ব্যাপক ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে অপরাধের প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব।