প্রজননশীলতা কী?

প্রজননশীলতা কী?

প্রজননশীলতা বা প্রজনন (Fertility) সামাজিক জনবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা একটি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এবং সমাজের সাংস্কৃতিক মানের উপর বিশাল প্রভাব ফেলে। প্রজননশীলতা বলতে সাধারণত একজন নারী বা নারীদের একটি গোষ্ঠীর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা বোঝানো হয়। এই ক্ষমতা জীববৈজ্ঞানিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। প্রজননশীলতা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করতে গেলে প্রথমে এর সংজ্ঞা, প্রভাব, এবং বিভিন্ন তত্ত্ব বুঝতে হবে।

প্রজননশীলতার সংজ্ঞা:
প্রজনন বলতে নারী বা নারীসমষ্টির সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা বোঝায়। এটি কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতগুলো সন্তান জন্ম দিয়েছেন তা হিসাব করে পরিমাপ করা হয়। প্রজননশীলতা মাপার ক্ষেত্রে এটি নির্ধারণ করা হয় যে কতটি সন্তান জীবিত জন্ম নিয়েছে। W.S. Thompson এবং D.T. Lewis এর মতে, “প্রজনন হলো একজন নারী বা নারীদের গোষ্ঠীর সন্তান জন্মদানের প্রকৃত নির্দেশক।” এই সংজ্ঞাটি সামাজিক জনবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়, যেখানে নারীর জন্মদানের ক্ষমতা এবং এটি কীভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে তা পর্যালোচনা করা হয়।

আরো পড়ুনঃ মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভূমিকা আলোচনা কর

J.R. Weeks প্রজননশীলতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “Fertility refers to the number of children born to women.” অর্থাৎ, নারীদের কতগুলো সন্তান হয়েছে তা এই প্রজনন ধারণার মধ্যে পড়ে। সামাজিক জনবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রজননশীলতা নারীর সন্তান জন্মদানের সংখ্যা এবং এই সংখ্যা কিভাবে সমাজ ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে তা বিশ্লেষণ করা হয়।

প্রজননশীলতার প্রভাব:
নারীর প্রজননশীলতা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর, যার মধ্যে রয়েছে নারীর শারীরিক স্বাস্থ্য, বয়স, সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাস। বিভিন্ন দেশে এবং অঞ্চলে প্রজননশীলতা ভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন উন্নত দেশগুলিতে, নারীরা প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে, এবং তারা সাধারণত কম সংখ্যক সন্তান ধারণ করে। অপরপক্ষে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নারীরা কম বয়সে সন্তান জন্ম দেয় এবং তুলনামূলকভাবে বেশি সন্তান ধারণ করে।

প্রজননশীলতার হার কম বা বেশি হওয়ার ফলে একটি দেশের অর্থনীতিতে বেশ বড় প্রভাব পড়তে পারে। যদি প্রজননশীলতার হার বেশি হয়, তবে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে অর্থনৈতিক চাপে পড়তে পারে। একইভাবে, কম প্রজননশীলতা দেশটির কর্মীসংখ্যা এবং উৎপাদনশীলতার উপর প্রভাব ফেলে। ফলে এটি একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

প্রজননশীলতার উপর প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়:
১. শারীরিক এবং স্বাস্থ্যগত কারণ: নারীর শারীরিক স্বাস্থ্য প্রজননশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন নারীর শারীরিক সক্ষমতা, তার খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুবিধা, এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতি বা অবনতি তার সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এছাড়া নারীর প্রজননশীলতা তার বয়সের উপরও নির্ভরশীল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নারীর প্রজননশীলতা কমে যায় এবং এক সময় এসে বন্ধ হয়।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস  বিফ সাজেশন

২. সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস এবং নিয়মাবলী নারীর প্রজননশীলতাকে প্রভাবিত করে। কিছু সমাজে, নারীকে সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করা হয় এবং এটি তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। কিছু সমাজে আবার নারীর স্বাধীনতা এবং প্রজননের উপর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমনকি প্রজননসংক্রান্ত ধর্মীয় বিশ্বাসও এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

৩. অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত কারণ: নারীর অর্থনৈতিক অবস্থা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রজননশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সাধারণত, শিক্ষিত নারীরা কম সংখ্যক সন্তান জন্ম দেয় কারণ তারা বেশি কর্মমুখী এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার দিকে মনোযোগী থাকে। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নারীরা সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতনতা অবলম্বন করে, যাতে তাদের পরিবার পরিকল্পনা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।

প্রজননশীলতার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব:
প্রজননশীলতার হার একটি দেশের জনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। একটি দেশের প্রজননশীলতার হার বেশি হলে, সেই দেশটির অর্থনৈতিক চাপ বাড়তে পারে। কারণ বেশি জনসংখ্যার জন্য খাদ্য, বাসস্থান, এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য বেশি সম্পদ প্রয়োজন। তবে প্রজননশীলতার হার অত্যন্ত কম হলে, দেশের কর্মীসংখ্যা কমে যেতে পারে, যা উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

এছাড়াও, প্রজননশীলতার হার জনসংখ্যার বয়সের গঠনকেও প্রভাবিত করে। একটি দেশের প্রজননশীলতা কমে গেলে, সেই দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং বৃদ্ধদের সংখ্যা বেড়ে যায়, যা একটি দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

আরো পড়ুনঃ অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের উদ্যোগ

উপসংহার: সবশেষে, প্রজননশীলতা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা জীববৈজ্ঞানিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ফ্যাক্টরের সাথে জড়িত। এটি নারী বা নারীর দল কতগুলো সন্তান জন্ম দেয় তা নির্দেশ করে এবং এই সংখ্যা সমাজ ও অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। প্রজননশীলতার হার দেশভেদে এবং সমাজভেদে পরিবর্তিত হতে পারে, এবং এটি কোনো দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, অর্থনৈতিক অবস্থা, এবং সামাজিক ব্যবস্থা গঠন করে। সুতরাং, প্রজননশীলতার গুরুত্ব বোঝা এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা একটি দেশের সমগ্র উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263