কল্যাণ রাষ্ট্র কি? কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলী
ভূমিকা: কল্যাণ রাষ্ট্র একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে সরকারের প্রধান দায়িত্ব হল জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকদের আর্থিক, সামাজিক ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সরকার বিশেষভাবে কাজ করে। মূলত কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা ২০শ শতকে বিকশিত হয়েছে, যার লক্ষ্য জনগণের সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা প্রদান করা।
কল্যাণ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা:
কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যা নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, সমান সুযোগ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। এটি এমন এক রাষ্ট্র যা দরিদ্র, অসুস্থ, অক্ষম এবং বেকারদের জন্য সরকারি সুবিধা প্রদান করে, যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তা।
আরো পড়ুনঃ শিল্প বিপ্লব কাকে বলে?
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
- Arther Sebirger বলেছেন, “কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সরকার নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে।”
- T.W. Kent বলেন, “কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা তার নাগরিকদের জন্য ব্যাপক সমাজসেবার ব্যবস্থা করে।”
- Barker বলেছেন, “কল্যাণ রাষ্ট্র হল এমন একটি রাষ্ট্র যা জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য দায়বদ্ধ।”
কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলি:
১. জনকল্যাণ সাধন: কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধন। এটি নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে রাষ্ট্র জনকল্যাণ নিশ্চিত করে।
২. নাগরিকদের নিরাপত্তা দান: কল্যাণ রাষ্ট্রে সরকার নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুর হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ।
৩. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: কল্যাণ রাষ্ট্র জনগণের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে রাস্তা, সেতু, রেলপথ, বিমানবন্দর, টেলিফোন, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য গণপরিবহন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত।
৪. অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দান: কল্যাণ রাষ্ট্র অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা করে। এ ধরনের রাষ্ট্র নাগরিকদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে সুরক্ষা দেয়।
৫. অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর: কল্যাণ রাষ্ট্র অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে রাজস্ব নীতি, কর ব্যবস্থা, রেশনিং এবং ভর্তুকির মাধ্যমে কাজ করে।
আরো পড়ুনঃ সমাজ সংস্কার কাকে বলে?
৬. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: কল্যাণ রাষ্ট্র জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করে। রাষ্ট্র নাগরিকদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করে তাদের জীবনের মান উন্নত করে।
৭. শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা: কল্যাণ রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ হল অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। আইন ও বিচার ব্যবস্থার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
৮. স্বাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠা: কল্যাণ রাষ্ট্র স্বাধীনতা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন করে। এটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের অধিকার সমানভাবে সংরক্ষণ করে।
৯. শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন: কল্যাণ রাষ্ট্র শিক্ষা বিস্তারের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সবার জন্য শিক্ষা সহজলভ্য করতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
১০. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: কল্যাণ রাষ্ট্র সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। এটি ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ এবং জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করে।
১১. প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ: কল্যাণ রাষ্ট্র প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে। এটি প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার রোধ করে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করে।
১২. চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা: কল্যাণ রাষ্ট্র নাগরিকদের চিত্তবিনোদনের জন্য পার্ক, মিউজিয়াম, খেলার মাঠ এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এর ফলে জনগণ শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে।
১৩. শ্রমিক কল্যাণ ও শ্রম আইন: কল্যাণ রাষ্ট্র শ্রমিকদের কল্যাণে বিশেষ শ্রম আইন প্রণয়ন করে। এটি শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে।
আরো পড়ুনঃ সামাজিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা
১৪. কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন: কল্যাণ রাষ্ট্র কৃষির উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি কৃষকদের প্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রদান এবং কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, কল্যাণ রাষ্ট্র জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে। এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও সুরক্ষা প্রদান করে। কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।