মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর।

ভূমিকা: দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষের নাম সিনেট। সিনেটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রতিনিধিমূলক সভা হিসেবে গণ্য করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি অনুসারে অঙ্গরাজ্যগুলো সমপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সিনেট গঠিত হয়। আয়তন ও জনসংখ্যা নির্বিশেষে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যে ২ জন করে প্রতিনিধি সিনেটে প্রেরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ৫০। তাই সিনেটের মোট সদস্য সংখ্যা হলো ১০০। মার্কিন সিনেটে এই সমপ্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা অনেকের মতানুসারে অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক।

সিনেটের গঠন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যসমূহের সমপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট গঠিত হয়। মার্কিন সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কোনো অঙ্গরাজ্যের সম্মতি ব্যতীত সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে সিনেটের সমপ্রতিনিধিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এভাবে ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল অঙ্গরাজ্যকে সমান প্রতিনিধিত্বের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। যদিও অনেকে এ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক বলে সমালোচনা করেছেন।

স্বল্প জনসংখ্যা বিশিষ্ট ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্যসমূহের সংখ্যা মোট সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের অধিক হওয়ায় তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সংবিধান সংশোধন, সন্ধি বা চুক্তি অনুমোদন; ইম্পিচমেন্টের বিচার প্রভৃতি কার্যে বাধা প্রদানে সক্ষম। কারণ, এসকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিনেটের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন।

এভাবে সংবিধান রচয়িতাগণ কার্যত: সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহৎ অঙ্গরাজ্যগুলো অপেক্ষা সংখ্যালঘিষ্ঠ রাজ্যসমূহের ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধিতা করেছেন বলে সমালোচকদের ধারণা।

সিনেটের সদস্য সংখ্যা: মার্কিন অঙ্গরাজ্যসমূহের আয়তন ও লোকসংখ্যার তারতম্য থাকলেও প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য থেকে সিনেটে দুই জন করে সদস্য নির্বাচিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা হলো ৫০টি। ফলে সিনেটে মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০।

সিনেট সদস্যদের যোগ্যতা: মার্কিন সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ধারায় সিনেট সদস্যদের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে।

ক. প্রার্থীর বয়স হবে সর্বনিম্ন ৩০ বছর;

খ. প্রার্থীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধারে ৯ বছর স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হবে;

গ. যে নির্বাচনি এলাকা থেকে নির্বাচন করবেন সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।

ঘ. সিনেটের সদস্য থাকাকালীন সময়ে কোনো ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কোনো চাকরিতে কর্মরত থাকতে পারবেন না।

ক্ষমতা ও কার্যাবলি: সিনেট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ হলেও এর কর্তৃত্ব ও মর্যাদা দ্বিতীয় কক্ষ অপেক্ষা অনেক বেশি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের উচ্চকক্ষের মধ্যে মার্কিন সিনেট সর্বাধিক শক্তিশালী হিসেবে সর্বজনবিদিত। নিম্নে মার্কিন সিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :

আরো পড়ুনঃ বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা কেন মান্য করা হয়?

১. আইনবিষয়ক ক্ষমতা: সাধারণ বিলের ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসের দুটি কক্ষ সিনেট ও প্রতিনিধি সভা সমক্ষমতাসম্পন্ন। সাধারণ বিল প্রতিনিধি সভার মতো সিনেটেও উত্থাপিত হতে পারে। আবার কোনো বিল পাসের জন্য প্রতিনিধি সভার সমর্থনই যথেষ্ট নয়, সিনেটের অনুমোদনও আবশ্যক।

২. শাসনবিষয়ক ক্ষমতা: সরকারি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও মার্কিন সিনেটে ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, পদস্থ কর্মচারী, রাষ্ট্রদূত, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রভৃতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন পদ যে সমস্ত নিয়োগ করেন তা সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষ।

৩. পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক ক্ষমতা: সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির মতামতকে আগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রপতির পক্ষে বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে নীতিনির্ধারণ বা তা কার্যকর করা সহজ ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষে সাধারণত বৈদেশিক ও সামরিক বিষয়ে সিনেটের উক্ত কমিটি ও নেতৃদলীয় সিনেটের সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন। কোনো বৈদেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো বিষয়ে আলাপ আলোচনা করার জন্য সিনেট রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করতে পারে।

৪. বিচার বিষয়ক ক্ষমতা: সিনেট গুরুত্বপূর্ণ বিচারবিষয়ক ক্ষমতার অধিকারী। মার্কিন রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিধি সভা অভিযোগ আনতে পারে। সিনেটই এই অভিযোগের অনুসন্ধান ও বিচার করে। ইমপিচমেন্ট পদ্ধতিতে বিচার করার ক্ষমতা একমাত্র সিনেটেরই আছে। এই রকম বিচারকার্যসম্পাদনের সময় সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি সভাপতিত্ব করে।

৫. নির্বাচনবিষয়ক ক্ষমতা: মার্কিন সংবিধান অনুসারে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে কেউ প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সিনেট অধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত প্রথম দুজন প্রার্থীর মধ্যে একজনে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করে না।

৬. তদন্ত করার ক্ষমতা: মার্কিন সিনেটের শাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত বা অনুসন্ধান পরিচালনা করার ক্ষমতাও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সিনেটের এ ধরনের অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। কমিটি নিয়োগ করে সিনেট যে কোনো পদস্থ সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারে।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস  বিফ সাজেশন

এ ধরনের অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে এসকল অনুসন্ধান কার্যের ‘লাইভ টেলিকাস্ট’ হয়, যা দেশের অভ্যন্তরেও অনেকে অতি আগ্রহের সাথে লক্ষ করে থাকে।

৭. সংবিধান সংশোধনমূলক ক্ষমতা: সিনেট সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ক্ষমতাও ভোগ করে। সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত সংবিধান সংশোধন কার্যকর হয় না। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব যখন কংগ্রেসে পাস হয় তখন সিনেটের দুই- তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি আবশ্যক হয় ।

৮. নির্বাচন সংক্রান্ত ক্ষমতা: অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে হলেও মার্কিন সিনেটের নির্বাচনমূলক ক্ষমতা রয়েছ। উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সিনেট সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত তিনজন প্রার্থীর মধ্যে থেকে একজনকে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করার ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।

৯. নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা: অনেকের মতে, মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ রাষ্ট্রপতি ও প্রতিনিধিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সিনেট গঠনের বিষয়টি মাথায় এনেছিলেন। এক্ষেত্রে ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি’-কে বাস্তবে রূপায়িত করার মাধ্যম হিসেবে সিনেটকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে মার্কিন সংবিধানে স্বল্প সদস্য বিশিষ্ট এবং স্থায়ী প্রকৃতি সম্পন্ন সিনেটের হাতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করে। এ সমস্ত ক্ষমতার সাহায্যে সিনেট রাষ্ট্রপতি ও প্রতিনিধি সভার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র মার্কিন প্রশাসনব্যবস্থায় এর প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়।

১০. চুক্তি ও সন্ধি অনুমোদন ক্ষমতা: শাসন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি যেসকল আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তি স্বাক্ষর করেন সেগুলোও সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষ। সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনুমোদন করলেই কেবলমাত্র এসব সন্ধি-চুক্তি কার্যকর হতে পারে; অন্যথায় এসমস্ত সন্ধি ও চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দলীয়ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে সিনেট রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত এসকল সন্ধি-চুক্তি মেনে নেয় ।

তবে সর্বদাই যে এসকল সন্ধি-চুক্তি মেনে নেয় তা কিন্তু নয় ৷ মাঝে মধ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্পাদিত সন্ধির চুক্তি বাতিল, আংশিক পরিবর্তন বা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯১৯ সালে রাষ্ট্রপতি উইলসন কর্তৃক স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি সিনেটের অনুমোদন পায়নি বিধায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘জাতিপুঞ্জে’ যোগদান করতে পারে নি।

১১. যুদ্ধ ঘোষণা: একমাত্র সিনেট যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা রাখে। সিনেটের সম্মতি ব্যতীত রাষ্ট্রপতি ৩ মাসের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য । অধ্যাপক লাস্কি (Laski) তাঁর “The American Democracy” গ্রন্থে বলেন, “Unaided by the Senate the American president is a sailor on a uncharteredship.”

১২. প্রশাসনিক ক্ষমতা: ভারত ও ব্রিটেনের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আইনসভার নিম্নকক্ষের হাতে ন্যস্ত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিনেট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কোন নিয়ােগ বৈদেশিক চুক্তি অনুমােদন না করলে তা কার্যকরী হয় না। অন্য কোন দেশের দ্বিতীয় কক্ষকে এরূপ ক্ষমতা দেয়া হয় নি।

আরো পড়ুনঃ ১৬০১ সালের এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইনের বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কিন শাসনবস্থায় সিনেটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; ক্ষমতা ও কার্যাবলির বিচারে সিনেট প্রতিনিধিসভার ঊর্ধ্বে অবস্থিত। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের আইনসভার উচ্চকক্ষের হাতে এত বেশি ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়নি। তাই মার্কিন সিনেটকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী উচ্চকক্ষ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252