জন লকের প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে ধারণা
ভূমিকা: জন লক (১৬৩২-১৭০৪) একজন প্রভাবশালী ইংরেজ দার্শনিক যিনি আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ “Two Treatises of Government” (১৬৯০)-এ তিনি সামাজিক চুক্তি ও প্রাকৃতিক অধিকার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। তার অন্যতম বিখ্যাত ধারণা হলো প্রকৃতির রাজ্য, যা রাষ্ট্রের বাইরে মানুষের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে। লক এই ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন, রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে মানুষ কীভাবে স্বাধীনভাবে বাস করত এবং কেন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। তার মতবাদ বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছে আমেরিকান এবং ফরাসি বিপ্লবে এবং আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশে।
প্রকৃতির রাজ্য: লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্য হল একটি আদিম অবস্থা, যেখানে মানুষ রাষ্ট্রের বাইরেও স্বাধীনভাবে বাস করে। এই রাজ্যে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন, সমান, এবং কোনো কর্তৃত্বের অধীন নয়। তারা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়, যা ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত এবং সকল মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রাকৃতিক আইন বলতে বোঝায় ন্যায়বিচারের সেই শাশ্বত নিয়ম, যা মানুষকে সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায় এবং একে অপরের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে বাধ্য করে।
আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ
লকের প্রকৃতির রাজ্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. স্বাধীনতা ও সমতার অধিকার: লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং সমান। এই স্বাধীনতার অর্থ হলো, তারা কারও অধীনে নয়, বরং নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারে। তারা তাদের নিজস্ব জীবন, স্বাধীনতা, এবং সম্পত্তি রক্ষা করার অধিকার রাখে। লকের মতে, এই স্বাধীনতা এবং সমতা হলো মানুষের মৌলিক প্রাকৃতিক অধিকার, যা কোনো শাসক বা প্রতিষ্ঠান হরণ করতে পারে না।
২. মানুষের যুক্তিসঙ্গততা: লক মনে করেন, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ যুক্তিসঙ্গত ও বুদ্ধিসম্পন্ন। মানুষ তার নিজের ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং অন্যের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সম্মান করার যোগ্যতা রাখে। লকের মতে, এই যুক্তি প্রাকৃতিক আইন মেনে চলার জন্য মানুষকে বাধ্য করে এবং এটি তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. সমাজবদ্ধতা ও সহযোগিতা: লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ সমাজবদ্ধ হয় এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জীবনযাপন করে। তারা পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে একে অপরের সাথে মিলে-মিশে থাকে এবং পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় সহযোগিতা করে। সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ফলে মানুষের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি হয়, যা তাদের সমষ্টিগত কল্যাণে সহায়ক।
৪. প্রাকৃতিক আইন মেনে চলা: লক মনে করেন, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ চিরন্তন ও শাশ্বত ন্যায়বিচারের নীতি বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এই প্রাকৃতিক আইন মানুষকে ন্যায়বিচারের দিকে পরিচালিত করে এবং অপরকে ক্ষতি না করার নীতি শেখায়। লকের মতে, প্রাকৃতিক আইনের নিয়মই প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবনকে সুশৃঙ্খল রাখে এবং তাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করে।
আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।
৫. সংঘাতের সম্ভাবনা: যদিও প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ স্বাধীন ও সমান, কিন্তু লক মনে করেন, এই অবস্থায় সংঘাতেরও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, মানুষ নিজের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার চেষ্টা করবে, যা অন্যদের স্বার্থের বিরোধিতা করতে পারে। সুতরাং, প্রকৃতির রাজ্যে অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় দ্বন্দ্ব এবং অরাজকতা দেখা দেয়।
৬. রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা: লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে সংঘাত ও অরাজকতার সম্ভাবনা থাকায় মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। রাষ্ট্রের মাধ্যমে মানুষ নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পারে এবং আইন ও শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে নিরাপদে বসবাস করতে পারে। লক বিশ্বাস করেন, মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে এবং শাসকদের ক্ষমতা প্রদান করে তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য।
লকের প্রকৃতির রাজ্য ও সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের সম্পর্ক:
লকের প্রকৃতির রাজ্য ধারণাটি তার সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের ভিত্তি। তিনি মনে করেন, মানুষ রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীনভাবে বাস করত। কিন্তু তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য তারা পরস্পরের সাথে একটি সামাজিক চুক্তি করে এবং রাষ্ট্র গঠন করে। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা শাসকের কাছে কিছু ক্ষমতা হস্তান্তর করে এবং শাসক তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে বাধ্য থাকে।
আরো পড়ুনঃ সংস্কৃতির সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, এবং উপাদানসমূহ
উপসংহার: লকের প্রকৃতির রাজ্য ধারণা আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করেছে। তার এই তত্ত্ব বিশেষভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার ধারণাকে সমর্থন করে। লকের মতে, রাষ্ট্রের মূল কাজ হলো মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করা। তার এই চিন্তাধারা আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন ও ফরাসি বিপ্লবের সময় গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং আজও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রচলিত ধারণাগুলির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।