গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য

গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।

ভূমিকা: গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র হলো দুটি ভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা, যা রাজনৈতিক বিশ্বে দুটি বিপরীত মেরুর প্রতিনিধিত্ব করে। গণতন্ত্রে জনগণই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। অন্যদিকে, একনায়কতন্ত্রে একজন ব্যক্তি বা দল রাষ্ট্রের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাখে এবং জনগণের মতামতকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে গণতন্ত্র প্রচলিত থাকলেও কিছু শক্তিশালী দেশে একনায়কতন্ত্রের অস্তিত্ব রয়েছে। এই লেখায় আমরা গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বিশ্লেষণ করব।

১. ক্ষমতার উৎস: 

গণতন্ত্রে: ক্ষমতার মূল উৎস হলো জনগণ। জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং তারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়। 

আরো পড়ুনঃ Sociology of Bangladesh Suggestion Session (2021-22)

একনায়কতন্ত্রে: ক্ষমতার উৎস একজন ব্যক্তি বা দল। তারা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনগণের মতামত বা সমর্থন প্রয়োজন মনে করে না।

২. ক্ষমতার বিস্তার: 

গণতন্ত্রে: ক্ষমতা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে জনগণের মধ্যে সমভাবে বিস্তৃত। একজন নির্বাচিত নেতা বা দল জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা নির্ধারণ করে। 

একনায়কতন্ত্রে: ক্ষমতা একজন ব্যক্তি বা দলের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। তাদের নির্দেশনা বা সিদ্ধান্তের বাইরে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। তারা প্রায়ই জোরপূর্বক বা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখে।

৩. ক্ষমতার হস্তান্তর: 

গণতন্ত্রে: ক্ষমতার হস্তান্তর নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ঘটে। নির্বাচন একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়া এবং জনগণের ভোটের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব ক্ষমতায় আসে। 

একনায়কতন্ত্রে: ক্ষমতার হস্তান্তর অনিয়মিত এবং প্রায়ই অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে। প্রায়শই অভ্যুত্থান বা রাজনৈতিক সংঘাতের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। সেনা অভ্যুথান বা গণ আন্দোলনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

৪. জনগণের ভূমিকা: 

গণতন্ত্রে: জনগণ শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের কার্যক্রম নির্ধারণ করতে এবং সরকারি সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতে পারে। তাদের মতামত সরকার পরিচালনায় গুরুত্ব পায়। 

একনায়কতন্ত্রে: জনগণ শাসনব্যবস্থার প্রায় নিষ্ক্রিয় অংশ। তাদের মতামতকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, এবং তারা শাসকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না।

৫. শাসনব্যবস্থা: 

গণতন্ত্রে: শাসনব্যবস্থা জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হয়। জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে এবং সেই প্রতিনিধি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়। 

আরো পড়ুনঃ Brief Suggestion of Political Organisation

একনায়কতন্ত্রে: শাসনব্যবস্থা একজন একক ব্যক্তি বা একটি দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শাসক গণপ্রতিনিধিত্বমূলক নয় এবং তাদের সিদ্ধান্তগুলি প্রায়ই ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা দলের স্বার্থে নির্ভরশীল থাকে।

৬. সাংবিধানিক রীতিনীতি: 

গণতন্ত্রে: সাংবিধানিক রীতিনীতি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং এর প্রতি কঠোরভাবে সম্মান জানানো হয়। কেউ ইচ্ছামতো সংবিধানের নিয়ম পরিবর্তন করতে পারে না। 

একনায়কতন্ত্রে: সাংবিধানিক রীতিনীতি প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়। শাসক তার সুবিধামতো সংবিধানের নিয়ম পরিবর্তন করে বা উপেক্ষা করে। জনগণের সামনে তাদের কোনো জবাবদিহিতা থাকে না।

৭. মানবাধিকার: 

গণতন্ত্রে: মানবাধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্যক্তির স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে। 

একনায়কতন্ত্রে: মানবাধিকার প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়। মত প্রকাশ, স্বাধীন চিন্তা, এবং রাজনৈতিক অধিকার সীমিত করা হয়, এবং শাসকের ইচ্ছামতো মানুষকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়।

৮. সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন: 

গণতন্ত্রে: সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত ঘটে। কারণ, শাসকরা জনগণের সেবা করতে বাধ্য থাকে এবং জনগণের সুনাম অর্জনের জন্য তাদের ভাগ্য উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়। 

একনায়কতন্ত্রে: সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ, শাসকগণ তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, যা জনগণের উন্নয়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

৯. সামগ্রিক বিচার:

গণতন্ত্র হলো একটি মুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক এবং সমতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা। এখানে জনগণের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা হয়। 

একনায়কতন্ত্র হলো স্বৈরাচারী, অবিচারী এবং বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা। এখানে শাসকগণ ব্যক্তিগত ইচ্ছামতো রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

আরো পড়ুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ

উপসংহার: গণতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্রের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো ক্ষমতা, জনগণের ভূমিকা, মানবাধিকার এবং শাসনব্যবস্থার গঠন। গণতন্ত্র হলো মানব কল্যাণের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা, যা জনগণের মতামত এবং স্বাধীনতাকে সম্মান করে। অপরদিকে, একনায়কতন্ত্র জনগণের অধিকারকে সীমিত করে এবং শাসকের ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান গণতন্ত্রের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252