গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও
ভূমিকা: গণতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনগণই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের ইচ্ছা ও মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং জনগণই সরকার গঠনের মূল চালিকাশক্তি। এই ব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসন কার্য সম্পন্ন করে। গণতন্ত্রের মূল নীতি হলো “জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন।”
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা:
গণতন্ত্র শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকে এসেছে। “ডেমোস” (demos) অর্থাৎ জনগণ এবং “ক্রাটোস” (kratos) অর্থাৎ শাসন, এই দুইটি শব্দের সমন্বয়ে “ডেমোক্রেসি” শব্দটি গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের মূল ভাবনা হলো জনগণের দ্বারা শাসন। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা গণতন্ত্রের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়।
আরো পড়ুনঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বিফ সাজেশন
১. আব্রাহাম লিংকন: গণতন্ত্রের সবচেয়ে প্রচলিত সংজ্ঞা আব্রাহাম লিংকন দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “গণতন্ত্র হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের শাসন।” এই সংজ্ঞার মাধ্যমে লিংকন বুঝিয়েছেন যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার জনগণের সেবা করার জন্য এবং তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য কাজ করে।
২. রবার্ট ডাল: রবার্ট ডালের মতে, “গণতন্ত্র হলো একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে জনগণ তাদের শাসক নির্বাচন করে এবং শাসকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হয়।” ডাল গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বমূলক দিকটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, গণতন্ত্রে জনগণই প্রকৃত শক্তির উৎস।
৩. লর্ড ব্রাইস: লর্ড ব্রাইস বলেন, “গণতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনসাধারণের মতামতই সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস।” তার মতে, জনগণের ইচ্ছাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত করে।
গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
১. জনগণের ক্ষমতা: গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হলো জনগণের ক্ষমতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের ইচ্ছার ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হয়। জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং সেই প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রের শাসন কার্য পরিচালনা করেন।
২. নির্বাচন ব্যবস্থা: গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যারা তাদের পক্ষ থেকে শাসন কার্য পরিচালনা করবে। নির্বাচন নিয়মিত সময় অন্তর অনুষ্ঠিত হয় এবং এর মাধ্যমে জনগণের মতামত ও ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে।
আরো পড়ুনঃ ডুরখেইমের যান্ত্রিক সংহতি
৩. মৌলিক অধিকার: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে। এসব অধিকার সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত থাকে এবং সরকার তা লঙ্ঘন করতে পারে না।
৪. আইনের শাসন: গণতন্ত্রের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আইনের শাসন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক, সরকার ও প্রতিষ্ঠান আইনের কাছে সমান এবং আইনের অধীনেই তাদের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আইনই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক এবং এর মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়।
৫. সংবিধানের প্রাধান্য: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানই সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস। সংবিধান দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এবং এর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন শাখার ক্ষমতা ও জনগণের অধিকার নির্ধারণ করা হয়। সরকার সংবিধানের অধীনে কাজ করে এবং সংবিধানের প্রতি বাধ্য থাকে।
৬. প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা মূলত প্রতিনিধিত্বমূলক। জনগণ সরাসরি শাসনে অংশগ্রহণ না করে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে। এই প্রতিনিধিরা জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
৭. সাংবিধানিক সংশোধন:
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধনের ব্যবস্থা থাকে। সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তিত চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা গণতন্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এই সংশোধন প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে পরিচালিত হয়।
গণতন্ত্রের প্রকারভেদ:
১. প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র: প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে জনগণ সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এই প্রতিনিধিরা জনগণের হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই শাসনব্যবস্থাই প্রচলিত।
২. সরাসরি গণতন্ত্র: সরাসরি গণতন্ত্রে জনগণ নিজেরাই সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে। যেমন প্রাচীন গ্রিসে এথেন্সে সরাসরি গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল, যেখানে জনগণ সরাসরি তাদের মতামত প্রদান করত এবং রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিত।
৩. উদার গণতন্ত্র: উদার গণতন্ত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়। এখানে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি কার্যক্রম সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
আরো পড়ুনঃ Political Organization and Political System of UK and USA Suggestion (2021-22)
৪. সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হলো এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালিত হয়। এখানে ব্যক্তিগত মালিকানার চেয়ে সাম্য ও সামাজিক কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
গণতন্ত্রের গুরুত্ব:
১. ব্যক্তিগত স্বাধীনতা: গণতন্ত্র ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিকের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে এবং তারা তাদের মতামতের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে।
২. জনগণের অংশগ্রহণ: গণতন্ত্রে জনগণের সরাসরি বা পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। এই অংশগ্রহণই গণতন্ত্রের মূল চালিকা শক্তি। জনগণ নিয়মিত নির্বাচন ও গণভোটের মাধ্যমে শাসনে অংশগ্রহণ করে।
৩. ন্যায়বিচার ও সাম্য: গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার ও সুযোগ থাকে এবং আইন সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হয়।
৪. দায়বদ্ধ সরকার: গণতন্ত্রে সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। সরকারের কর্মকাণ্ডের জন্য জনগণ সরকারের জবাবদিহি দাবি করতে পারে। এর ফলে সরকারকে সতর্কভাবে কাজ করতে হয় এবং এটি জনগণের কল্যাণে সহায়ক হয়।
উপসংহার: গণতন্ত্র একটি সুশাসিত ও মানবিক শাসনব্যবস্থা, যা জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের ইচ্ছাই সরকারের কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়।