ডুরখেইমের যান্ত্রিক সংহতি
ভূমিকা: সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম স্থপতি হিসেবে পরিচিত। তিনি সমাজের কাঠামো, সংহতি এবং পরিবর্তনের উপর বিশ্লেষণধর্মী কাজ করেছেন। ডুরখেইমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো “সামাজিক সংহতি” (Social Solidarity), যা সমাজের অখণ্ডতা ও সমন্বয়ের রূপ।
ডুরখেইম মূলত দুই ধরনের সামাজিক সংহতির কথা বলেছেন: যান্ত্রিক সংহতি এবং জৈবিক সংহতি। যান্ত্রিক সংহতি মূলত প্রাচীন ও প্রাক-শিল্প সমাজের সংহতির রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে মানুষ একই ধরনের কাজ ও চিন্তাধারার সাথে সম্পর্কিত থাকে, এবং সামাজিক বন্ধন সাদৃশ্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে।
যান্ত্রিক সংহতি কী?
ডুরখেইমের মতে, যান্ত্রিক সংহতি একটি প্রাথমিক ধরণের সামাজিক সংহতি, যা সাধারণত প্রাক-শিল্পায়িত সমাজে বিদ্যমান। এই সংহতির মূল ভিত্তি হলো সাদৃশ্য এবং অভিন্ন চিন্তাধারা। একে যান্ত্রিক বলা হয়, কারণ এই ধরনের সমাজে মানুষ একটি একক কাঠামোর অংশ হিসেবে কাজ করে, যেখানে প্রত্যেকে প্রায় একই ধরণের কাজ করে এবং একই ধরণের জীবন যাপন করে। এই ধরনের সংহতির ক্ষেত্রে, ব্যক্তির চেয়ে সমাজের সম্মিলিত চেতনাই বেশি প্রাধান্য পায়।
যান্ত্রিক সংহতির বৈশিষ্ট্যগুলো:
১. সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি: যান্ত্রিক সংহতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে সাদৃশ্য থাকা। প্রাক-শিল্প সমাজে মানুষ প্রায় একই ধরনের কাজ করে, যেমন কৃষিকাজ, পশুপালন ইত্যাদি। তাদের জীবনের ধারা এবং চিন্তাভাবনা খুবই অভিন্ন থাকে। ফলে সামাজিক সংহতি দৃঢ় হয়।
আরো পড়ুনঃ মানব ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
২. ব্যক্তির চেয়ে সমাজের গুরুত্ব: এই সমাজে ব্যক্তির চেয়ে সমাজের সম্মিলিত চেতনার গুরুত্ব বেশি। ব্যক্তি তার নিজের ইচ্ছার চেয়ে সামাজিক নিয়ম-কানুন মেনে চলে। ব্যক্তির স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা থাকে এবং সমাজের আদর্শ ও নৈতিকতার সঙ্গে তার জীবনযাপন নির্ধারিত হয়।
৩. নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: যান্ত্রিক সংহতির সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হল বাহ্যিক নিয়ম এবং আইন। সামাজিক রীতিনীতি এবং প্রথা কঠোরভাবে পালন করা হয়, এবং এর ব্যতিক্রমকে কঠোরভাবে দমন করা হয়। মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম-কানুন থাকে যা সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
৪.শ্রম বিভাজন কম: যান্ত্রিক সংহতির সমাজে শ্রমবিভাজন তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সবাই প্রায় একই কাজ করে থাকে এবং বিশেষায়িত কাজের প্রয়োজন খুব কম থাকে। ফলে ব্যক্তির বিশেষ দক্ষতার চেয়ে সমষ্টিগত দক্ষতাকে বেশি মূল্য দেওয়া হয়।
৫. সামাজিক ঐক্য: যান্ত্রিক সংহতি সামাজিক ঐক্যের ভিত্তিতে তৈরি। মানুষ তাদের কাজ, ধর্ম, বিশ্বাস এবং আচার-আচরণের মাধ্যমে একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত থাকে। তাদের মধ্যে একটি ভ্রাতৃত্ববোধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা থাকে যা সমাজকে একত্রে ধরে রাখে।
৬. শাস্তির ব্যবস্থাপনা: এই ধরনের সমাজে আইন ও বিচারব্যবস্থা কঠোর এবং শাস্তির ব্যবস্থা কঠিন। সামাজিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কঠোর শাস্তির মাধ্যমে সেটি দমন করা হয়। শাস্তির মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের ঐক্য বজায় রাখা এবং সমাজের নিয়মকানুনের প্রতি সকলের শ্রদ্ধা নিশ্চিত করা।
যান্ত্রিক সংহতির উদাহরণ:
ডুরখেইমের যান্ত্রিক সংহতির উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজকে দেখা যেতে পারে। এই ধরনের সমাজে প্রায় সবাই কৃষিকাজের সাথে যুক্ত থাকে, এবং তাদের জীবনধারা খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ হয়। সবাই একই ধরনের আচার-অনুষ্ঠান পালন করে, ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাস করে, এবং একে অপরের প্রতি গভীরভাবে নির্ভরশীল থাকে। এই ধরনের সমাজে ব্যতিক্রমী আচরণ খুব কম থাকে, এবং সকলের মধ্যে একটি অভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
ডুরখেইমের দৃষ্টিভঙ্গি:
ডুরখেইম বিশ্বাস করতেন যে, যান্ত্রিক সংহতি প্রাথমিক সমাজে প্রভাবশালী থাকলেও, আধুনিক সমাজের অগ্রগতির সাথে সাথে এটি ক্রমাগত জৈবিক সংহতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন যে আধুনিক সমাজে শ্রমবিভাজন বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বেড়েছে। ফলে যান্ত্রিক সংহতি আধুনিক সমাজে অপ্রতুল হয়ে উঠেছে এবং এর জায়গায় জৈবিক সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম পরিচিতি সাজেশন Exam-2024
উপসংহার: যান্ত্রিক সংহতি প্রাক-শিল্পায়িত সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যেখানে সমাজের সদস্যদের মধ্যে অভিন্ন চিন্তা, আচরণ এবং মূল্যবোধের ভিত্তিতে সংহতি গড়ে ওঠে। এই ধরনের সংহতি সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হলেও, আধুনিক সমাজে এর প্রভাব কমে গেছে। ডুরখেইমের মতে, আধুনিক সমাজে জৈবিক সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক নির্ভরতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবুও, যান্ত্রিক সংহতির ধারণা সামাজিক গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।