বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা কি?
ভূমিকা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial Review) হলো একটি আইনি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আদালত সরকারের কোনো আইনি ব্যবস্থা বা কর্মসূচির বৈধতা পরীক্ষা করে। এটি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সংবিধানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে মান্য করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে বিচার বিভাগ সরকারের নীতিমালা, আইন এবং কার্যক্রমকে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নির্ধারণ করে। এতে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং সরকারকে সংবিধান অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য করা হয়।
আরো পড়ুনঃ সংবিধানের সংজ্ঞা দাও
ইতিহাস:
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার উদ্ভব হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮০৩ সালে মারবেরি বনাম ম্যাডিসন মামলায়। এই মামলায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে যে সংবিধানের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে আদালত সংবিধানের ভিত্তিতে আইন বা কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করার ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে বিচার বিভাগ সরকারের যে কোনো শাখার আইনি কার্যক্রমকে পরীক্ষা করার সুযোগ পায়।
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার সুবিধা:
১. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সরকারের কার্যক্রমকে সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রাখতে বাধ্য করে। এর মাধ্যমে সংবিধানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. সরকারের ক্ষমতা সীমিতকরণ: বিচার বিভাগ সরকারের যেকোনো শাখার ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে সক্ষম হয়। এতে সরকার সংবিধান বহির্ভূত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না এবং তাদের কার্যক্রম সংবিধানের শর্ত অনুযায়ী সীমাবদ্ধ থাকে।
৩. নাগরিকদের অধিকার রক্ষা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করতে সহায়ক হয়। যদি কোনো আইন বা সরকারি পদক্ষেপ নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে, তবে আদালত সেই পদক্ষেপকে বাতিল করতে পারে।
আরো পড়ুনঃ চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পার্থক্য কি?
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার অসুবিধা:
১. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার কারণে সরকারের কার্যক্রমে বিলম্ব হতে পারে, যা কখনো কখনো প্রশাসনিক কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে সরকার কার্যকরভাবে নীতি বাস্তবায়নে অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে।
২. আদালতের ক্ষমতা বৃদ্ধি: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ফলে আদালতের ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে, যা বিচার বিভাগের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
৩. রাজনৈতিক বিতর্কের সম্ভাবনা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা কোনো আইনি বা রাজনৈতিক ইস্যুতে বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। কারণ, আদালতের সিদ্ধান্ত সবসময় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে এবং এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশেও বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধানের ১০৪(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সর্বোচ্চ আদালত যে কোনো আইন, উপবিধি, সরকারি সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনার বৈধতা যাচাই করতে পারে। এই পর্যালোচনার মাধ্যমে আদালত সংবিধান এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উদাহরণ:
আরো পড়ুনঃ ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলো কী কী?
১. ১৯৭২ সালের “বাংলাদেশ কোর্টস (অ্যামেন্ডমেন্ট) আইন” বাতিল করা হয়েছিল বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে। ২. ২০০৮ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় জারি করা ৩৪টি অধ্যাদেশও বাতিল করা হয় সর্বোচ্চ আদালতের এই ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে।
উপসংহার: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা সরকারকে সংবিধানের অধীনে পরিচালিত করতে বাধ্য করে এবং নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক হয়। তবে এটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যাতে আদালতের ক্ষমতা বৃদ্ধি না পায় এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত না হয়।