বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কী বোঝো? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় সমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিচারকগণ যদি স্বাধীন থাকতে না পারেন, তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই কোন বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে বিচারকগণকে অবশ্যই সততা, বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করতে হবে। জনগণের স্বাধীনতা দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের উপর নির্ভরশীল। যার জন্য বিচার বিভাগকে সর্বদা সর্বপ্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত থাকতে হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণের উপায়ঃ বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে লর্ড ব্রাইসের মতামত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, কোন দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে তার বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা।
আরো পড়ুনঃ বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা কেন মান্য করা হয়?
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা যেসব কার্যকারণের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় এবং যেসব পন্থা অনুসৃত হলে বিচারকগণ নির্ভয়ে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেগুলো নিম্নরূপঃ
১. সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতি অবলম্বনঃ স্বাধীন বিচার বিভাগের সুষ্ঠু ভূমিকা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে নিয়োগ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে নিয়োগ করা হয়। যথাঃ
ক. আইনসভা কর্তৃক (Election by the legislature),
খ. জনগণ কর্তৃক (Election by the people) এবং
গ. প্রধান নির্বাহী কর্তৃক (Nomination by the chief executive)।
আইনসভা ও জনগণ কর্তৃক বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি জটিল ও কঠিন এবং তা থেকে প্রত্যাশিত ফল আশা করা যায় না। তাই বর্তমানে প্রধান নির্বাহী কর্তৃক বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে। যোগ্যতম বিচারক নিয়োগের এটাই হচ্ছে উত্তম উপায়। তবে প্রধান নির্বাহী যদি বিচারপতিদের নিয়োগের ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় মন্ত্রী এবং বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির সুপারিশক্রমে নিয়োগ দান করেন তাহলে আর কোন প্রকার অসুবিধা থাকে না।
বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রেই প্রধান নির্বাহী কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। এ পদ্ধতির সমর্থকগণ মনে করেন যে, প্রধান নির্বাহী সর্বাপেক্ষা যোগ্যতম কর্তৃপক্ষ, যিনি যথাযোগ্য যোগ্যতা অনুসারে বিচারপতিদের নিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু সমালোচকগণ মনে করেন যে, এতে বিচারকদের উপর প্রধান নির্বাহীর রাজনৈতিক প্রাধান্য ও প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা থেকে যায়।
ফলে বিচারকগণ সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে পারে না। তবে প্রধান নির্বাহী যদি বিচারপতিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি সুপারিশক্রমে নিয়োগ দান করেন তাহলে আর কোন প্রকার অসুবিধা থাকে না। অধ্যাপক লাস্কিও এ মত পোষণ করেছেন।
২. বিচার বিভাগ কর্তৃক নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণঃ বিচার বিভাগ নাগরিকদের পৌর অধিকার এবং সংবিধানে সন্নিবেশিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষা করে ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিচার বিভাগ নাগরিকদের উপর্যুক্ত অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করতে গিয়ে কয়েকটি বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে। এ পদ্ধতিসমূহ নিম্নরূপঃ
ক. হেবিয়াস কর্পাস (Habeas corpus),
খ. ম্যানডেমাস (Mandamus),
গ. সার্সিওয়ারি (Certioari) এবং
ঘ. কোয়ারেন্টো (Quowarranto)।
রিট আবেদন বা হুকুমনামাসমূহ জারি করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের রয়েছে। এদের মাধ্যমে অধিকার বঞ্চিত যে কোন ব্যক্তির আবেদনক্রমে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে বিচারের জন্য আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতে পারে।
৩. বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণঃ অধ্যাপক লাস্কি মন্তব্য করেছেন, শাসকের হাতে বিচারের ভার ন্যস্ত থাকলে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। এরকম ক্ষেত্রে শাসন বিভাগ সহজেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আইন ও শাসন বিভাগ থেকে তার স্বতন্ত্রীকরণ অপরিহার্য।
আরো পড়ুনঃ ডুরখেইমের জৈবিক সংহতি
প্রাচীন কালে রাজা বা রাজকর্মচারীরাই আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। আগে শাসনকার্য ও বিচারকার্যের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হতো না। এ ব্যবস্থা স্বৈরাচারের সুযোগ করে দেয়। ইতিহাসে এর সমর্থন পাওয়া যায়। বর্তমানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির আংশিক প্রয়োগ বলতে এ বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণকে বুঝায়।
৪. বিচারকদের কার্যকালঃ বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্ব তাদের নির্ভীকভাবে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করে। কার্যকালের স্থায়িত্বের অভাবে তাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। কার্যকাল মেয়াদের অনিশ্চয়তা, অপসারণ পদ্ধতির নমনীয়তা, বিচারপতিদের শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং রাজনৈতিক পদাধিকারীদের উপর নির্ভরশীল করে তোলে।
বিচারকদের পদচ্যুতি করার ক্ষমতা কোন অবস্থাতেই শাসন বিভাগের উপর ন্যস্ত করা উচিত নয়। কেবলমাত্র বিচার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তাদের মারাত্মক চারিত্রিক দোষ প্রমাণিত হলে বিচারকদের কার্যকাল এবং চাকরি থেকে পদচ্যুতি করা যাবে।
৫. অবসর গ্রহণের পর আদালতে ওকালতি বন্ধের ব্যবস্থাঃ বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের অধীনে তাদের ওকালতি নিষিদ্ধ করা উচিত। অবসর গ্রহণের পর আদালতে ওকালতি করলে বা কোন কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করলে বিচার বিভাগের রায় ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার জন্য পূর্বতন পরিচয় ও প্রভাবকে তারা প্রয়োগ করতে পারেন।
বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখতে হলে অবসর গ্রহণের পর তাদের সরকারি ও বেসরকারি পদে নিয়োগ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা উচিত।
৬. বিচারপতিদের কাজের সমালোচনাঃ বিচারপতিদের কাজের সমালোচনার উপর বাধানিষেধ আরোপ করা দরকার। বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে নির্ভীকভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।
৮. বিচারকদের পদোন্নতিঃ বিচারকদের কর্মক্ষমতা নির্ভর করে তাদের কর্মসম্পাদনের ইচ্ছার উপর। এ ইচ্ছা আবার নির্ভর করে মূলত পদোন্নতির আশার উপর। কাজেই বিচারকদের পদোন্নতির বিষয়টি অতি যত্নের সাথে বিবেচনা করা উচিত। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ নীতির ভিত্তিতেই পদোন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয়; তবে বিশেষ কোন ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা এবং মেধাও পদোন্নতির ভিত্তি হতে পারে।
৯. চাকরি থাকাকালীন সুযোগ সুবিধাঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিচারকদের উচ্চতম বেতন ও ভাতার সুব্যবস্থা, চাকরিতে থাকাকালীন চাকরির স্থায়িত্ব প্রদান এবং উচ্চহারে অবসরজনিত ভাতার সুব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। বেতনের পর্যাপ্ততা এবং নিরাপত্তা বিচারকদের সঠিকভাবে কর্তব্য সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করে। এ দিকটির উপর লক্ষ্য রেখে অধিকাংশ রাষ্ট্রই বিচারকদের বেতনাদি এবং চাকরির শর্তাবলি সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে।
আরো পড়ুনঃ মহানগরীতে বস্তি বৃদ্ধির কারণ
১০. কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতাঃ আদালতে স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য আর একটি ব্যবস্থাও বিশেষভাবে প্রয়োজন। আদালতের কার্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা আদালতের হাতেই ন্যস্ত করা উচিত।
১১. বিচারকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেক সময় বিচারকগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে।
১২. বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখাঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এটিকে আইন বিভাগ বা শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত রাখতে হবে। এ ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য সাংবিধানিক বিধিবিধান প্রয়োগ আবশ্যক।
বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে, ফলে শাসন বিভাগের একচ্ছত্র আধিপত্য রোধ করতে হলে বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা একান্ত আবশ্যক।
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সংকীর্ণ আইনানুগ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। সে কারণেই বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। এজন্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কি বলেন, “বিচার ব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রদর্শন নিরপেক্ষ হতে পারে না।”