১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলি

ভূমিকা: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক সংগ্রাম। পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্তির জন্য বাংলাদেশিরা এক অভূতপূর্ব যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করে। এই যুদ্ধের সময় সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সামরিক সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের নিজস্ব কমান্ডার, যুদ্ধ কৌশল, ও কর্মপন্থা ছিল, যা সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ পরিচালনাকে সংগঠিত ও কার্যকর করেছিল। এই সেক্টরগুলোই মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনার মূল কাঠামো হিসেবে কাজ করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে ১১টি মূল সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল এবং প্রতিটি সেক্টরের জন্য নির্ধারিত কমান্ডার, প্রতিরক্ষা অঞ্চল এবং লক্ষ্য ছিল। এছাড়া, ১০ ও ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার পরিবর্তন করা হয়েছিল।

১. সেক্টর নং ১:

  • কমান্ডার: মেজর জিয়াউর রহমান
  • অঞ্চল: চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা।
  • অভিযান এলাকা: এই সেক্টরের মূল কাজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। পাহাড়ি এলাকাগুলোয় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা এবং সমুদ্রপথে পাকিস্তানি সরবরাহ লাইন ধ্বংস করাও ছিল তাদের কাজের অংশ।

২. সেক্টর নং ২:

  • কমান্ডার: মেজর খালেদ মোশাররফ
  • অঞ্চল: ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, এবং মেঘনার পশ্চিম তীর।
  • অভিযান এলাকা: এই সেক্টরের অধীনে ছিল ঢাকা শহরকে বিচ্ছিন্ন করা এবং গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে ফেলা।

৩. সেক্টর নং ৩:

  • কমান্ডার: মেজর কে এম শফিউল্লাহ
  • অঞ্চল: ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।
  • অভিযান এলাকা: এই সেক্টরের প্রধান লক্ষ্য ছিল ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে তাদের শক্তি ক্ষয় করা।

৪. সেক্টর নং ৪:

  • কমান্ডার: মেজর সি আর দত্ত
  • অঞ্চল: সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।
  • অভিযান এলাকা: সিলেট ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করা এবং তাদের শক্ত ঘাঁটি ধ্বংস করা ছিল এই সেক্টরের অন্যতম লক্ষ্য।

৫. সেক্টর নং ৫:

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি চিত্র

  • কমান্ডার: মেজর মীর শওকত আলী
  • অঞ্চল: সিলেটের পূর্বাঞ্চল এবং মেঘালয়ের কিছু অংশ।
  • অভিযান এলাকা: এই সেক্টরের কাজ ছিল সিলেটের উত্তর এবং পূর্বাঞ্চল রক্ষা করা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করা।

৬. সেক্টর নং ৬:

  • কমান্ডার: ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর) মোহাম্মদ আবু তাহের
  • অঞ্চল: রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, এবং ঠাকুরগাঁও।
  • অভিযান এলাকা: উত্তরের এই সেক্টরের কাজ ছিল রংপুর এবং ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত করা।

৭. সেক্টর নং ৭:

  • কমান্ডার: মেজর নাজমুল হক (প্রথমদিকে), পরবর্তীতে কর্নেল আবু তাহের
  • অঞ্চল: রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা।
  • অভিযান এলাকা: এই সেক্টর রাজশাহী এবং পাবনা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করার পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের সামরিক অবস্থান দুর্বল করত।

৮. সেক্টর নং ৮:

  • কমান্ডার: মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, পরবর্তীতে কর্নেল এম এ মান্নান
  • অঞ্চল: যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা।
  • অভিযান এলাকা: যশোর এবং খুলনা অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা এবং সরবরাহ লাইন ধ্বংস করা ছিল এই সেক্টরের অন্যতম লক্ষ্য।

৯. সেক্টর নং ৯:

  • কমান্ডার: মেজর এম এ জলিল
  • অঞ্চল: বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা।
  • অভিযান এলাকা: দক্ষিণাঞ্চলের এই সেক্টর বরিশাল এবং পটুয়াখালী অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করত।

১০. সেক্টর নং ১০:

  • কমান্ডার: কমান্ডার (নৌবাহিনী) এম এ খান (পরবর্তীতে অন্যেরা দায়িত্ব নেন)
  • অঞ্চল: নদীবাহিনী (বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্রবন্দর সংক্রান্ত কার্যক্রম)।
  • অভিযান এলাকা: এই সেক্টরের কাজ ছিল বাংলাদেশের নদী এবং সমুদ্রপথে পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহ লাইন ধ্বংস করা এবং নৌযুদ্ধ পরিচালনা করা।

১১. সেক্টর নং ১১:

  • কমান্ডার: মেজর সফিউল্লাহ
  • অঞ্চল: কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এবং ঝিনাইদহ।
  • অভিযান এলাকা: এই সেক্টর পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে কুষ্টিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে মুক্ত রাখার জন্য সংগ্রাম করত।

সেক্টরগুলোর ভূমিকা এবং যুদ্ধের ফলাফল:

এই সেক্টরগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করেছিল। প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের শক্তি দুর্বল করা হয়েছিল, যার ফলে যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত আক্রমণ এবং ভারতের মিত্রবাহিনীর সাথে যৌথ অভিযান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় নিশ্চিত করে।

আরো পড়ুনঃ সমাজ বিজ্ঞান পরিচিতি বিগত সালের প্রশ্ন

উপসংহার: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ভিত্তিক যুদ্ধ পরিচালনা ছিল অত্যন্ত কার্যকর এবং সফল একটি পন্থা। প্রতিটি সেক্টরের নিজস্ব কৌশল ও কমান্ডারদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করার জন্য এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম পরিচালনা করেন। এই সেক্টরগুলোই মুক্তিযুদ্ধের সময় যোদ্ধাদের শক্তি এবং সামর্থ্যের সমন্বয় সাধন করে, যা শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252