অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের উদ্যোগ

অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের উদ্যোগ

ভূমিকা: উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের উদ্যোগ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সময়, বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ এবং সংশয় দেখা দেয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই সময়ে একটি স্বাধীন ও অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়কে একত্রিত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা। এ পরিকল্পনা বাংলার জন্য একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রয়াস ছিল, যা পরবর্তীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রয়াস:

১. উদ্দেশ্য: অখণ্ড বাংলা গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল:

  • উপমহাদেশের সকল বাঙালিকে একত্রিত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা।
  • বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা।
  • বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা।

২. পটভূমি: অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রেক্ষাপট ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময়ের রাজনৈতিক জটিলতা। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে স্বাধীনতার সাথে সাথেই মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, যার ফলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান গঠনের পরিকল্পনা করা হয়।

বাংলায় তখন অনেক রাজনৈতিক নেতা, বিশেষ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম, বাংলাকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। তাঁদের মতে, অখণ্ড বাংলা গঠন হলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন এড়ানো যাবে এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

আরো পড়ুনঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলি

৩. অখণ্ড বাংলা গঠনের কার্যক্রম: অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রয়াসে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল:

  • প্রচার ও জনমত গঠন: বাংলার জনগণের মধ্যে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। বিশেষ করে বাংলার মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের নেতারা বাঙালি জনগণের কাছে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেন।
  • আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা: ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ের নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করে অখণ্ড বাংলা গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিশেষ করে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আলোচনা হয়।
  • রাজনৈতিক সংগ্রাম: রাজনৈতিক পর্যায়ে অখণ্ড বাংলার পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়।

চূড়ান্ত ফলাফল:

১. অখণ্ড বাংলা গঠনের ব্যর্থতা: অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এর প্রধান কারণ ছিল মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব এবং বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে মতভেদ। মুসলিম লীগের একটি অংশ এবং কংগ্রেস দুই পক্ষই বাংলাকে একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে আপত্তি জানায়। এছাড়া ব্রিটিশ শাসকরা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের কারণে বাংলার বিভক্তিকে সমর্থন করে।

২. দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গঠন: অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর ফলে বাংলাও বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয় এবং পশ্চিম বাংলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই বিভাজন বাঙালি জাতির ঐক্যকে চিরতরে বিভক্ত করে এবং বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর উপর গভীর প্রভাব ফেলে।

৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাবের ব্যর্থতা সত্ত্বেও, এই প্রয়াস বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলা বিভক্ত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এর ফলে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়।

আরো পড়ুনঃ সমাজ বিজ্ঞান পরিচিতি বিগত সালের প্রশ্ন

৪. স্বাধীনতা সংগ্রামের মাইলফলক: অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রচেষ্টা এবং তার ব্যর্থতা বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসনের চেতনা আরও গভীর করে। এর মাধ্যমে বাংলার জনগণ বুঝতে পারে যে, তাঁদের নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। এই চেতনা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত স্বাধীনতা লাভের পথ প্রশস্ত করে।

উপসংহার: অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রয়াস একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল, যা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। যদিও এই উদ্যোগটি সফল হয়নি, তবুও এটি বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকে। বাংলার জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে এবং স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরদার করে এই প্রচেষ্টা বাঙালির ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি গঠন করেছিল।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252