আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল

ভূমিকা: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, যার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাঙালি নেতৃত্বকে দুর্বল ও কোণঠাসা করার পরিকল্পনা ছিল। তবে এ ষড়যন্ত্রই বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও উজ্জীবিত করে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরিচয়:

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। এই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগীরা ভারতের আগরতলা শহরে গিয়ে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করছেন। মামলায় শেখ মুজিবসহ ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাকিস্তানি সরকারের দাবি ছিল, তারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

আরো পড়ুনঃ বাংলা নামের উৎপত্তি

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ:

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল, যা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করতে প্ররোচিত করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো:

১. শেখ মুজিবুর রহমানকে দমন: শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য এক কঠোর আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল, যা আইয়ুব খানের সরকারকে ভীত করে তোলে। তাঁর জনপ্রিয়তাকে দমনের জন্য সরকার শেখ মুজিবকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছিল।

২. বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন: পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। এই আন্দোলন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। ফলে বাঙালিদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ষড়যন্ত্রের মামলা করা হয়।

৩. ছয় দফার প্রভাব: শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জনগণের জন্য ছয় দফা দাবি তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ছয় দফার দাবি মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিল, যা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা মেনে নিতে পারেনি। ফলে এই ছয় দফার আন্দোলন দমনে ষড়যন্ত্র করা হয়।

৪. আইয়ুব খানের ক্ষমতার স্থায়িত্ব: আইয়ুব খান তার দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন এবং এজন্য তিনি বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন তাঁর শাসনের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, এবং এটি দমাতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৫. ছাত্র আন্দোলন: তৎকালীন ছাত্র সমাজ ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই আন্দোলন শেখ মুজিবের ছয় দফার সাথে সম্পর্কিত ছিল এবং এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। এই আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং দমন করতে আইয়ুব সরকার মামলা দায়ের করে।

আরো পড়ুনঃ ৬-দফা আন্দোলনকে কেন বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলা হয়?

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল:

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রত্যাশিত ফলাফল না এলেও, এটি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এটি বাঙালির জাতীয় চেতনাকে আরও উজ্জীবিত করেছিল এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

১. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণ-অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ছাত্র সমাজ এবং সাধারণ জনগণ শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। এর ফলে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ঘটে, যা তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতনের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

২. শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলে শেখ মুজিব একজন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। এ মামলায় শেখ মুজিবকে দোষী সাব্যস্ত করার প্রচেষ্টা তাঁকে বাঙালির চোখে জাতির নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে।

৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে বাঙালিরা আরও বেশি করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হওয়ার সত্যটি উপলব্ধি করে। বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অধীনে থেকে তাদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। এই সত্যই বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উজ্জীবিত করে।

৪. স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ সুগম: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে। এই মামলা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে তোলে। মামলাটির পর বাঙালিরা তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আরও সংগঠিত হয় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে।

আরো পড়ুনঃ ৬ দফা আন্দোলন কি? 

উপসংহার: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে দমাতে চেয়েছিল। তবে এই ষড়যন্ত্রই বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও জোরদার করে এবং জনগণের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আরও দৃঢ় করে। ফলে এই মামলাটি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252