রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক পদ্ধতি

রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক পদ্ধতি

ভূমিকা: রাষ্ট্রের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব ও মতবাদ রয়েছে। এর মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক তত্ত্ব সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সাধারণভাবে স্বীকৃত মতবাদ। এই তত্ত্ব অনুসারে, রাষ্ট্র আকস্মিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টি হয়নি; বরং এটি মানবসমাজের ক্রমবিকাশ ও দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। প্রফেসর গার্নার, লীকক, বার্জেস, ম্যাকআইভার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই তত্ত্বের সমর্থক। তারা দেখিয়েছেন, অন্যান্য মতবাদ অসম্পূর্ণ এবং যুক্তিযুক্ত নয়। বিবর্তনমূলক তত্ত্বই রাষ্ট্রের সঠিক উৎপত্তির ব্যাখ্যা প্রদান করে।

ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক তত্ত্বের মূল বক্তব্য

বিবর্তনমূলক তত্ত্বের প্রধান বক্তব্য হলো রাষ্ট্র হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। মানবসমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যে উপাদানগুলো ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রভাব ও চাপে সমাজের গঠন বদলেছে, তা থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। বর্তমান রাষ্ট্র একটি সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ক্রমবিবর্তনের ফলাফল। এ কারণে রাষ্ট্রকে একটি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক বিকাশের অংশ হিসেবে দেখা হয়।

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির সম্পর্ক

অধ্যাপক গার্নার-এর মতে, “রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্টি নয়, দৈহিক বল প্রয়োগের ফলও নয়, কোনাে প্রস্তাব বা সম্মেলনের দ্বারা রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়নি; এমনকি পরিবারের সম্প্রসারণের ফলে এর সৃষ্টি হয়নি। রাষ্ট্র কোনো কৃত্রিম বা যান্ত্রিক উপায়ে সৃষ্টি নয়, রাষ্ট্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে।”

অধ্যাপক লীকক বলেন, “মানুষের ইতিহাসের জানা-অজানা অধ্যায় হতে রাষ্ট্র বিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে।”

রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক/বিবর্তনমূলক তত্ত্বের উপাদানসমূহ

রক্তের সম্পর্ক: রক্তের সম্পর্ক হলো রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম প্রাথমিক উপাদান। আদিম যুগে পরিবার ও কৌমসমাজগুলো রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত হতো। রক্তের সম্পর্ক পরিবারগুলোর মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি করত, যা পরে বৃহৎ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। একক পরিবার গোষ্ঠীতে একত্রিত হয়ে সমাজ গঠন করতে শুরু করে এবং পরে তা রাষ্ট্র গঠনের পথে অগ্রসর হয়।

ধর্ম: প্রাথমিক সমাজগুলোতে ধর্ম ছিল সমাজে শৃঙ্খলা ও একতার মূল উপাদান। ধর্মীয় বিধি-বিধান মানুষকে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ রাখত এবং তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করত। ধর্মীয় নেতারা সমাজের মানুষকে ধর্মীয় আদেশ-নিষেধের মাধ্যমে শাসন করতেন। ধর্মই তখন মানুষকে একত্রিত করে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি স্থাপন করে।

যুদ্ধ: যুদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। যাযাবর জীবনের অবসান ঘটিয়ে মানুষ যখন একটি স্থানে বসবাস করতে শুরু করে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণার বিকাশ ঘটে, তখন সম্পদ রক্ষার জন্য এক উপজাতি অন্য উপজাতির সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধের মাধ্যমে একজন নেতা বা দলপতি স্বীকৃতি অর্জন করেন, যিনি পরবর্তীতে শাসক বা রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এভাবেই যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন হয়।

আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানে অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান

অর্থনৈতিক চেতনা: অর্থনৈতিক চেতনার বিকাশ রাষ্ট্রের উদ্ভবকে ত্বরান্বিত করেছে। আদিম যুগে মানুষ সমবেতভাবে খাদ্য সংগ্রহ ও শিকার করত। তবে পশুপালন এবং কৃষিকাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক বৈষম্য ও চৌর্যবৃত্তির জন্ম দেয়। এই সামাজিক অসংগতির কারণে মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, যা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করে।

রাজনৈতিক চেতনা: অর্থনৈতিক চেতনার পাশাপাশি রাজনৈতিক চেতনার বিকাশও রাষ্ট্রের উদ্ভবকে ত্বরান্বিত করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজের নেতা বা দলপতিদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য থাকলেও, পরবর্তীকালে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তি ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য মানুষ একজন শাসকের অধীনে আসতে ইচ্ছুক হয়। এভাবেই রাজনৈতিক চেতনার বিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

“রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, সৃষ্টি হয়নি” উক্তির বিশ্লেষণ

“রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, সৃষ্টি হয়নি” এই উক্তিটি রাষ্ট্রের ক্রমবিবর্তন ও ধীরগতিতে গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট সময় বা ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট নয়, বরং এটি মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনের ফলে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। মানবসমাজে পরিবার, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং যুদ্ধের প্রভাবে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা ও শাসনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। এসব কারণে সমাজের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের গঠনও বিকশিত হয়েছে।

আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব

উপসংহার বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্র আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়নি; বরং এটি মানুষের সমাজের ক্রমবিকাশের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক চেতনা, যুদ্ধ এবং ধর্মীয় সংহতি রাষ্ট্র গঠনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাই বলা যায়, রাষ্ট্র হলো দীর্ঘ বিবর্তনের ফল, যা কোনো একক ঘটনা বা শক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252