যুক্ত ফ্রন্ট কী?
যুক্ত ফ্রন্ট (Jukto Front / United Front) ছিল পূর্ব বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত এক ঐক্যবদ্ধ জোট, যা ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে যুগান্তকারী বিজয় অর্জন করে। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এই জোট গঠিত হয় মূলত বাংলা ভাষার মর্যাদা, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, কৃষক-শ্রমিকের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিকে সামনে রেখে।
নিচে যুক্ত ফ্রন্ট সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো তালিকাভুক্তভাবে তুলে ধরা হলো—
-
গঠনের সংজ্ঞা ও সময়:
যুক্ত ফ্রন্ট ছিল পূর্ব বাংলার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি নির্বাচনী জোট, যা ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে একত্রভাবে প্রার্থী দিয়ে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধের জনসমর্থনকে সংগঠিত করা। -
গঠনের প্রেক্ষাপট:
-
মুসলিম লীগ সরকারের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও জনগণের মৌলিক দাবিগুলো উপেক্ষা করা।
-
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া এবং ভাষা আন্দোলনের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর আচরণ।
-
অর্থনৈতিক বৈষম্য, কৃষক-শ্রমিকের জন্য ন্যায্য অধিকার ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির দাবির প্রতি উদাসীনতা।
এসব কারণেই বিরোধী শক্তিগুলো একত্র হয়ে যুক্ত ফ্রন্ট গঠন করে।
-
-
যুক্ত ফ্রন্টের প্রধান দল ও নেতৃত্ব:
যুক্ত ফ্রন্ট মূলত চারটি বড় রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত ছিল—-
আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ)
-
কৃষক শ্রমিক পার্টি (Krishak Sramik / Krishak Praja Party)
-
নেজামে ইসলাম পার্টি
-
গণতান্ত্রিক দল (Ganatantri Dal)
নেতৃত্বে ছিলেন তিন জন প্রভাবশালী নেতা— -
শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক
-
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
-
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
-
-
একুশ দফা কর্মসূচি:
যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচনে নামে একটি ঐতিহাসিক “একুশ দফা কর্মসূচি” নিয়ে, যার মূল দিকগুলো ছিল—-
বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান
-
জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি ও কৃষকদের ন্যায়সঙ্গত জমি বণ্টন
-
শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন ও বেকারত্ব দূরীকরণ
-
পূর্ব বাংলার ন্যায্য অধিকার, অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও বাজেটে অংশ বৃদ্ধি
-
ভাষা শহীদদের স্মৃতিরক্ষা, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ঘোষণা ইত্যাদি
এই কর্মসূচির কারণেই যুক্ত ফ্রন্ট সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে।
-
-
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্ত ফ্রন্টের ভূমিকা ও বিজয়:
-
১৯৫৪ সালের ৮–১২ মার্চ পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
-
এই নির্বাচনে যুক্ত ফ্রন্ট মুসলিম লীগকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে—
-
মোট ৩০৯ আসনের মধ্যে যুক্ত ফ্রন্ট জোট পায় প্রায় ২২৩টির বেশি আসন, আর মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন।
-
-
নির্বাচনের ফলাফলে এ. কে. ফজলুল হক পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন।
-
-
যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের পতন:
যুক্ত ফ্রন্ট সরকার খুব বেশি দিন টিকতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ‘অব্যবস্থাপনা’ ও ‘স্বাধীনতাবাদী প্রবণতা’র অভিযোগ তুলে কয়েক মাসের মধ্যে যুক্ত ফ্রন্ট মন্ত্রণালয় ভেঙে দেয় এবং গভর্নর শাসন জারি করে। এর ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের ক্ষোভ আরও বাড়ে এবং ভবিষ্যতে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। -
বাংলার রাজনীতিতে যুক্ত ফ্রন্টের গুরুত্ব:
-
প্রথমবারের মতো পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ ব্যালটের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট মতামত জানায়।
-
বাংলা ভাষা, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবি নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে সাংগঠনিক রূপ পায়।
-
১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনকে অনেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও পরবর্তীকালের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেন।
-
সব মিলিয়ে, যুক্ত ফ্রন্ট ছিল পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী জোট, যা ভাষা, অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বাঙালির গণরায়কে একত্রিত করে ভবিষ্যতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি আরও শক্ত করে।