ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা করো।

Avatar
calender 17-11-2025

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি মূলত এক গভীর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও জাতিগত সংকট থেকে জন্ম নিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসন শেষে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলেও পূর্ব বাংলার মানুষ দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকারকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে, আর তারা প্রশাসন, শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে শুধু উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বাংলাভাষী মানুষের অস্তিত্ব, পরিচয় ও সম্মান কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, আর সেখান থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপণ করে।

বাংলা ভাষাভাষীর বৈষম্য
• পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠই বাংলাভাষী হলেও তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
• বাংলা ভাষাকে অবমূল্যায়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক দমন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা মূলত পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে।
• প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে বাংলা ব্যবহার সীমিত করার উদ্যোগে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি
• ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
• এই ঘোষণা পূর্ব বাংলার মানুষকে গভীরভাবে আহত করে, কারণ তারা বুঝতে পারে—নিজস্ব ভাষা হারিয়ে গেলে জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ও হারিয়ে যাবে।
• ছাত্রসমাজ এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠে এবং বিভিন্ন সংগঠন একত্রিত হয়ে প্রতিবাদের ডাক দেয়।

রাজনৈতিক বৈষম্য ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ
• পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে, যার ফলে পূর্ব বাংলাকে ক্রমাগত শোষণের শিকার হতে হয়।
• ভাষার প্রশ্নটি শুধু ভাষাগত নয়, বরং রাজনৈতিক বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
• ভাষা আন্দোলন তাই ধীরে ধীরে সাংবিধানিক অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রূপ নেয়।

ছাত্রসমাজের সংগঠিত প্রতিরোধ
• ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম থেকেই ভাষা রক্ষার আন্দোলনে মুখ্য নেতৃত্ব দেয়।
• তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তুলে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, ধর্মঘট ও মিছিলের আয়োজন করে।
• তমিজউদ্দিন খান, কাজী গোলাম মাহবুব, আব্দুল মতিনসহ অসংখ্য ছাত্রনেতা এই আন্দোলনকে সংগঠিত করেন।

রাষ্ট্রের দমনপীড়ন
• সরকার ভাষা আন্দোলন দমনে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
• ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ছাত্ররা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়।
• সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেক তরুণ শহীদ হন, যা ভাষা আন্দোলনকে নতুন শক্তি এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়।

ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
• ১৯৫৬ সালের সংবিধানে অবশেষে বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়, যা আন্দোলনের বড় জয়।
• এই আন্দোলন বাঙালির জাতীয় চেতনা গঠনে মূল ভূমিকা রাখে ও স্বাধীনতার পথ সুগম করে।
• ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতিকে পরিচয়, অধিকার ও সম্মানের প্রশ্নে এক নতুন জাগরণে উজ্জীবিত করে।

এইভাবে দেখা যায়, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি শুধুমাত্র ভাষা নয়; বরং অধিকার, মর্যাদা, রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার এবং জাতিগত পরিচয় রক্ষার সংগ্রামের সমন্বিত ফলাফল।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD