সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
ভূমিকা: সমাজবিজ্ঞান হলো একটি ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞান, যা সমাজবদ্ধ মানুষের জীবন, সামাজিক দিক, এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎকে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রথমবারের মতো ‘Sociology’ শব্দটি ব্যবহার করেন এবং এই সময় থেকেই সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ: সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। মানুষ যুগের পর যুগ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং এসব সমস্যার সমাধানের প্রয়াস থেকেই সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব হয়।
উৎপত্তি: সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। তবে সাধারণভাবে, সমাজবিজ্ঞানের জন্ম ফ্রান্সে বলে মনে করা হয়। সেই সময় ফ্রান্সে রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এই অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ফরাসি দার্শনিকরা সমাজের গঠন এবং কার্যকলাপ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন, যা সমাজবিজ্ঞানের জন্ম দেয়।
আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ
সমাজবিজ্ঞান অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের তুলনায় নবীন হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশের আলোচনা করতে গিয়ে কিছু বিশিষ্ট দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের অবদানের দিকে নজর দেওয়া দরকার।
অগাস্ট কোঁৎ: অগাস্ট কোঁৎকে সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ফ্রান্সের তৎকালীন সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখে সমাজ পুনর্গঠনের চিন্তা করেন। সমাজ বিশ্লেষণের জন্য তিনি ‘Social Physics’ নামে একটি নতুন বিজ্ঞানের জন্ম দেন, যা পরবর্তীতে ১৮৩৯ সালে ‘Sociology’ নামে পরিচিতি পায়। কোঁৎ তার ‘Positive Philosophy’ গ্রন্থে সমাজের তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ করেন: ধর্মতান্ত্রিক স্তর, দার্শনিক স্তর, এবং বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। কোঁৎ-ই প্রথম সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এরিস্টটল: গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল, প্লেটোর ছাত্র, তার Polities এবং Ethics গ্রন্থে বাস্তবভিত্তিক সমাজ কাঠামোর রূপরেখা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “মানুষ সামাজিক জীব, যে সমাজে বাস করে না, সে হয় দেবতা না হয় পশু।” এরিস্টটলের এই বক্তব্য মানুষের সমাজে বসবাসের প্রয়োজনীয়তা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
হামুরাবি সনদ: খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন ব্যাবিলনে হামুরাবি সনদ প্রণীত হয়। এটি প্রাচীনকালের প্রথম লিখিত আইন, যেখানে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের অধিকার ও কর্তব্য লিপিবদ্ধ ছিল। এই সনদ থেকে প্রাচীন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়, যা সমাজবিজ্ঞানের ধারণার শুরুর দিকের নিদর্শন।
প্লেটো: গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার Republic গ্রন্থে সমাজ সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা তুলে ধরেন। প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামো এবং শ্রেণিবিন্যাস সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। তার সমাজ দর্শন আধুনিক সমাজব্যবস্থার বিকাশে প্রভাব ফেলেছে।
ম্যাকিয়াভেলি: ইতালির দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি তার The Prince গ্রন্থে সমাজের কাঠামো এবং শাসকের গুণাবলি নিয়ে বাস্তববাদী আলোচনা করেন। তার বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারায় প্রভাব ফেলে এবং সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়।
ইবনে খালদুন: ইবনে খালদুন মুসলিম দার্শনিক হিসেবে বিখ্যাত। তার মুকাদ্দিমা গ্রন্থে তিনি ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি এবং সামাজিক শক্তিসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ইবনে খালদুনের সমাজ সম্পর্কিত চিন্তাধারা এতটাই সমাজতাত্ত্বিক যে তাকে অনেকেই সমাজবিজ্ঞানের পূর্বসূরি হিসেবে মনে করেন।
ভিকো: ভিকো সমাজব্যবস্থা বিবর্তিত হয় এ তত্ত্ব দেন এবং তার দর্শনের নাম দেন ‘The New Science’। ভিকো সমাজের বিবর্তনের ধারায় তিনটি যুগের কথা উল্লেখ করেন: দেবতাদের যুগ, যোদ্ধাদের যুগ, এবং মানুষের যুগ।
হেগেল: হেগেল প্রথম সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করেন। তিনি বলেন, মানুষের আর্থিক তাগিদে সমাজের সৃষ্টি হয়। এই পৃথকীকরণের মাধ্যমে সমাজের বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে।
আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব
মন্টেস্কু: ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তার The Spirit of the Laws গ্রন্থে ভৌগোলিক পরিবেশ কীভাবে রাষ্ট্র এবং সমাজব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে, তা আলোচনা করেন। তার এই বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
হার্বার্ট স্পেনসার: হার্বার্ট স্পেনসার সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি জীববিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান থেকে ধারণা গ্রহণ করে সমাজকে একটি সচেতন ও ক্রমবিকাশমান সত্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। স্পেনসারের এই চিন্তাধারা সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কার্ল মার্কস: কার্ল মার্কস সমাজবিজ্ঞানে শ্রেণীসংগ্রামের ধারণা নিয়ে আসেন। তার দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব সমাজের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কস সমাজের স্তরবিন্যাসের তত্ত্ব প্রদান করেন, যা সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ডুরখেইম: এমিল ডুরখেইম সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে অনন্য অবদান রাখেন। তিনি তার The Division of Labour in Society এবং Suicide গ্রন্থে সমাজ বিশ্লেষণে বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন। ডুরখেইমের কাজ সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা এবং বিকাশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
ম্যাক্স ওয়েবার: ম্যাক্স ওয়েবার সমাজবিজ্ঞানে ব্যক্তিকে গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, এবং আমলাতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেন। তার The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism গ্রন্থে তিনি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে নতুন মাত্রা যোগ করেন।
চার্লস ডারউইন: সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে চার্লস ডারউইনের অবদান উল্লেখযোগ্য। তার লেখা The Origin of Species জীববিজ্ঞানের পাশাপাশি সামাজিক বিবর্তনের ওপরও প্রভাব ফেলে। ডারউইন জীবজগতের বিবর্তন তত্ত্ব প্রদান করেন, যা সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বিকাশে সহায়ক হয়।
সিগমন্ড ফ্রয়েড: সিগমন্ড ফ্রয়েড অস্ট্রিয়ান মনোবিশ্লেষক ছিলেন। তিনি মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি, এবং সভ্যতার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেন। তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান: ফরাসি দার্শনিক ফ্রেডারিক লো প্লে, আমেরিকান সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গান, এবং ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেইলরও সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
উপসংহার: সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের চিন্তা এবং গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে সমাজবিজ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। আজকের সমাজবিজ্ঞান মানবসমাজের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণে একটি প্রভাবশালী শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।