সংস্কৃতির সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, এবং উপাদানসমূহ

সংস্কৃতির সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, এবং উপাদানসমূহ

ভূমিকা: আমরা যেমন, তেমনি আমাদের সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে এবং সমাজে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সৃষ্টি করেছে। সমাজে তাদের জীবনযাত্রার ধারা, আচার-অনুষ্ঠান, চিন্তাভাবনা এবং নানান সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের ফলে যে উপাদান তৈরি হয়, তাকেই সংস্কৃতি বলা হয়। সংস্কৃতি হলো মানুষ এবং সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়বাহী উপাদান। আদিম সমাজ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার বিকাশ এবং মানবজীবনের উন্নয়নে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতির জন্য সংস্কৃতি একটি অপরিহার্য মাধ্যম।

সংস্কৃতির সংজ্ঞা: সংস্কৃতি শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Culture, যা ল্যাটিন শব্দ Cultura থেকে এসেছে। বাংলা ভাষায় এর অর্থ হলো কৃষ্টি। “কৃষ্টি” শব্দটি মূলত “চাষ করা” বা “কর্ষণ” অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই সংস্কৃতিকে শাব্দিক অর্থে বলা যায় মানুষের নিজেদের চর্চা ও সৃষ্টির ফল। সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষ সমাজে তার চিন্তাভাবনা, আচার-অনুষ্ঠান, এবং জীবনের অভিজ্ঞতা সংহত করে।

আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, এবং নৃবিজ্ঞানী সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা দেয়।

  • ই. বি. টেইলর (E. B. Tylor): তার Primitive Culture গ্রন্থে সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “সংস্কৃতি হলো একটি জটিল ও সামগ্রিক সভা, যেখানে রয়েছে জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নীতিবোধ, আইন এবং সামাজিক মানুষের অর্জিত যাবতীয় দক্ষতা।”
  • জোনস (Jones): “মানব সৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি।”
  • ম্যালিনোস্কি (Malinouski): “সংস্কৃতি হলো মানুষের সৃষ্ট কাজের মাধ্যম, যার মাধ্যমে মানুষ তার উদ্দেশ্য অর্জন করে।”
  • স্যামুয়েল কোনিগ (Samuel Koening): “সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের প্রচেষ্টার সমন্বিত রূপ, যার মাধ্যমে সে তার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে।”
  • ম্যাকাইভার ও পেজ (MacIver and Page): “সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তা এবং প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড, যা তার শিল্পকলা, সাহিত্য, এবং ধর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।”
  • হার্বাট স্পেন্সার (Herbert Spencer): “সংস্কৃতি হলো একটি অতি জৈবিক পরিবেশ যা জীবজন্তু এবং বৃক্ষরাজির দ্বারা প্রাত্যহিক পরিবেশ থেকে পৃথক।”

সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য:

সংস্কৃতি হলো মানুষের সামাজিক জীবনের প্রতিফলন, যা সমাজের চিন্তা, মূল্যবোধ, এবং কর্মধারার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। সংস্কৃতির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সমাজ ও মানুষের জীবনযাত্রার ধরণ নির্দেশ করে।

১. সংস্কৃতি মানব সৃষ্ট: সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি মানব সৃষ্ট। মানুষ তার চিন্তাশক্তি, দক্ষতা, এবং সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে সংস্কৃতি তৈরি করে। মানুষের আবিষ্কৃত প্রতিটি বিষয়, যেমন—বাস্তবিক (বস্তুগত) বা চিন্তাগত (অবস্তুগত) সবকিছুই সংস্কৃতির অংশ।

২. সংস্কৃতির ভিন্নতা: সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর ভিন্নতা। স্থান, সময় এবং সমাজের পার্থক্যের কারণে সংস্কৃতির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। সমাজভেদে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-অনুষ্ঠান ভিন্ন হতে পারে। যেমন, পশ্চিমা সমাজের সংস্কৃতি এবং আমাদের দেশের সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

৩. সংস্কৃতি অর্জনযোগ্য: সংস্কৃতি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া কোনো জিনিস নয়; বরং এটি সমাজের মধ্যে থেকে শিখতে হয়। মানুষ সমাজে বাস করে এবং সেখানে চলমান প্রথা, আচরণ, এবং চিন্তাভাবনা থেকে সংস্কৃতি অর্জন করে।

৪. অংশীদারিত্বমূলক: সংস্কৃতি কোনো একক ব্যক্তির বিষয় নয়; এটি সমাজের সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে তৈরি হয়। সমাজের সকল সদস্যের অভিজ্ঞতা ও অভ্যাসের মাধ্যমে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তাই সংস্কৃতি একটি সম্মিলিত অর্জন, যা সমাজের সবাই ভাগাভাগি করে।

আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা

৫. সামাজিক: সংস্কৃতি সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানুষ সামাজিক জীব এবং সমাজের ভেতরেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বাস করে এবং একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে সংস্কৃতির সৃষ্টি করে।

৬. গতিশীল: সংস্কৃতি কখনও স্থির থাকে না; বরং এটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা ও পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। প্রাচীনকালের সংস্কৃতির সঙ্গে বর্তমানের সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

৭. জৈবিক ও ধারণাগত: সংস্কৃতি কখনও কখনও জৈবিক বলে বিবেচিত হয়, কারণ এটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য গড়ে ওঠে। আবার এটি ধারণাগতও, কারণ সংস্কৃতি চিন্তা ও ধারণার মাধ্যমে গঠিত হয় এবং সমাজে এর প্রয়োগ ঘটে।

৮. উদ্দেশ্য সাধনের উপায়: সংস্কৃতি হলো মানুষের উদ্দেশ্য পূরণের একটি মাধ্যম। মানুষ তার প্রয়োজন পূরণের জন্য যে কার্যকলাপ করে এবং যে কৌশল উদ্ভাবন করে, তা সংস্কৃতির অন্তর্গত। সংস্কৃতির কোনো কাজ উদ্দেশ্যহীন নয়।

৯. অর্জিত আচরণ: সংস্কৃতি হলো মানুষের অর্জিত আচরণ। মানুষ সমাজে বসবাস করে এবং সমাজ থেকে যে আচরণ শিখে তা সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। যেমন, সামাজিকীকরণের মাধ্যমে মানুষ সমাজের ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, এবং আচরণ রপ্ত করে।

আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানে অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান

১০. ভাষা ও সংস্কৃতি: ভাষা হলো সংস্কৃতির প্রধান বাহন। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ তার চিন্তা, ধ্যান-ধারণা এবং জ্ঞান আদান-প্রদান করে। সংস্কৃতি ও ভাষার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ভাষা সংস্কৃতির বিকাশ এবং সংরক্ষণের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

১১. বিনিময়যোগ্য: সংস্কৃতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর বিনিময়যোগ্যতা। বিভিন্ন সমাজের মধ্যে সাংস্কৃতিক লেনদেন ঘটে। যদিও বস্তুগত সংস্কৃতি সহজে পরিবর্তন হয়, কিন্তু অবস্তুগত সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন—পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের সমাজে লক্ষ্য করা যায়।

১২. সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল: যেমন সমাজ পরিবর্তনশীল, তেমনি সংস্কৃতিও পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা, মূল্যবোধ, এবং প্রযুক্তির বিকাশের কারণে সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে। বর্তমান সমাজের সংস্কৃতির সঙ্গে অতীতের সংস্কৃতির তুলনা করলে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়।

১৩. পার্থিব ও আধ্যাত্মিক দিক: সংস্কৃতির দুটি দিক রয়েছে—পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক। মানুষ পার্থিব চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন কাজ করে, যেমন—অর্থনৈতিক কার্যকলাপ। অন্যদিকে আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ শিল্পকলা, সাহিত্য, এবং সঙ্গীতের মতো সৃষ্টিশীল কাজ করে।

১৪. চলমান: সংস্কৃতি কখনোই স্থির থাকে না; এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানুষের অভিজ্ঞতা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। অতীতের অর্জন থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়।

১৫. সঙ্গতিপূর্ণ ও সুসংহত: সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি সঙ্গতিপূর্ণ এবং সুসংহত। সমাজের বিভিন্ন উপাদান এবং কার্যকলাপ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে। সংস্কৃতি তার নিজের উন্নয়নের জন্য একটি সঙ্গতিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে।

১৬. শিক্ষণীয়: সংস্কৃতি কোনো জৈবিক বংশগতি নয়; বরং এটি শেখা যায়। মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে সংস্কৃতি শেখে এবং সমাজে সে সংস্কৃতির প্রয়োগ ঘটে।

আরো পড়ুনঃ রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা | আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর ভূমিকা

উপসংহার: সংস্কৃতি কোনো একটি নির্দিষ্ট সমাজের সামগ্রিক পরিচয়বাহী উপাদান। এটি সমাজের মানুষের জীবনধারা, চিন্তা, এবং ধ্যান-ধারণাকে প্রতিফলিত করে। পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও উপাদানগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, তবে সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এবং মানবজীবনকে উন্নত ও সার্থক করার জন্য সংস্কৃতির ভূমিকা অপরিসীম। সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষ তার জীবনকে সুন্দর, সুস্থ, এবং সার্থক করতে সক্ষম হয়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252