সামাজিক নিরাপত্তা বলতে কি বুঝায়?

সামাজিক নিরাপত্তা বলতে কি বুঝায়?

ভূমিকা: সামাজিক নিরাপত্তা হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যা আর্থিক ও সামাজিক অসচ্ছলতার মোকাবিলায় রাষ্ট্র বা সমাজ কর্তৃক প্রদান করা হয়। জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ যেমন বেকারত্ব, বার্ধক্য, রোগ বা দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট আর্থিক সংকটে সাহায্য করার জন্য সরকার বা সমাজের পক্ষে পরিচালিত বিভিন্ন কর্মসূচি এবং সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়াই সামাজিক নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য। এটি সাধারণত অস্থায়ী বা স্থায়ী আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, যা একটি দেশের নাগরিকদের জীবনে স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।

সামাজিক নিরাপত্তার পরিচয়:

সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করা হয়। যেমন- বার্ধক্য, অক্ষমতা, বেকারত্ব, পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তির মৃত্যু প্রভৃতির মতো অবস্থায় এই সাহায্য প্রদান করা হয়। এর লক্ষ্য হলো নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি দেওয়া। সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা মূলত রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হলেও এর মধ্যে বেসরকারি সংস্থাও জড়িত থাকতে পারে।

আরো পড়ুনঃ শিল্প বিপ্লব কাকে বলে?

সামাজিক নিরাপত্তার সংজ্ঞা:

সামাজিক নিরাপত্তার ধারণা বহু মনীষী ও সংস্থা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো:

  • আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (ILO):
    “সামাজিক নিরাপত্তা হল এমন একটি নিরাপত্তা যা যথোপযুক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ কর্তৃক প্রদান করা হয় যখন মানুষ বিশেষ বিপদাপদের সম্মুখীন হয়। এসব বিপদাপদ এমনকি আকস্মিক দুর্ঘটনা যে স্বল্প আয়ের ব্যক্তিবর্গ স্বীয় সামর্থ্য ও উদ্যোগের দ্বারা মোকাবিলা করতে অপরাগ।”
  • স্যার উইলিয়াম বিভারেজ:
    “বেকারত্ব, অসুস্থতা বা দুর্ঘটনা, বৃদ্ধ বয়সে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ, পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তির মৃত্যু অথবা জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ের সময় অস্বাভাবিক ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন পরিবারের উপার্জন বা আয়ের পথ বন্ধ হলে যে কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের উপার্জন বা আয়ের নিশ্চয়তা দান করা হয় তাই সামাজিক নিরাপত্তা।”
  • W. A. Friedlander:
    “অসুস্থতা, বেকারত্ব, উপার্জনকারীর মৃত্যু, বার্ধক্য কিংবা নির্ভরশীলদের অক্ষমতা এবং দুর্ঘটনা ইত্যাদি যখন ব্যক্তি তার নিজের চেষ্টায় মোকাবিলা করতে পারে না তখন সামাজিক আইনের মাধ্যমে যেসব প্রতিরক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় তাকেই সামাজিক নিরাপত্তা বলে।”

সামাজিক নিরাপত্তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:

সামাজিক নিরাপত্তার প্রধান লক্ষ্য হলো নাগরিকদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি প্রদান এবং তাদের জীবনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে নাগরিকদের জীবনের মান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। এর কয়েকটি মূল লক্ষ্য নিম্নরূপ:

আরো পড়ুনঃ সমাজসেবা কাকে বলে? সমাজসেবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

১. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রদান: সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে বেকারত্ব, বার্ধক্য বা অসুস্থতার কারণে যারা উপার্জন করতে পারে না, তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রদান করা হয়। এতে তারা নিজেদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে পারে।

২. দারিদ্র্য দূরীকরণ: সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য দূর করা। দরিদ্র ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের ন্যূনতম আয় ও জীবনধারণের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

৩. সামাজিক বৈষম্য হ্রাস: সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করা হয়। সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এটি কাজ করে।

৪. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান: সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে বিনামূল্যে বা কম খরচে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার কারণে আর্থিক ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫. আর্থিক সুরক্ষা ও পুনর্বাসন: যেসব পরিবার বা ব্যক্তি দুর্যোগ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে বিপদে পড়ে, তাদেরকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ ধরনের পুনর্বাসন কর্মসূচি তাদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

আরো পড়ুনঃ দারিদ্রের দুষ্টুচক্র কাকে বলে

সামাজিক নিরাপত্তার উপাদানসমূহ:

সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা মূলত নিচের উপাদানগুলোর ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়:

১. বৃদ্ধভাতা ও পেনশন: যারা বার্ধক্যের কারণে কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন, তাদের জন্য পেনশন বা বৃদ্ধভাতা প্রদান করা হয়।

২. বেকারভাতা: যারা বেকার, তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।

৩. চিকিৎসা সহায়তা: অসুস্থতা বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে যারা চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারে না, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হয়।

৪. নিরাপত্তা বীমা: দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা মৃত্যুজনিত কারণে যারা আর্থিক সঙ্কটে পড়ে, তাদেরকে সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তা বীমা চালু করা হয়।

আরো পড়ুনঃ

উপসংহার: সামাজিক নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা মানুষের জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, এবং বেকারত্ব মোকাবেলার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি দেশ তার নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252